1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পুলিশ যখন সমাজ সংস্কারক!

১ জানুয়ারি ২০২১

বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র বা ফর্মুলা মুভিতে পুলিশের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী৷ বলা যায়, নায়ক, নায়িকা, ভিলেন আর কৌতুকাভিনেতার মতোই পুলিশ একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র৷

https://p.dw.com/p/3nR2k
Bangladesch Polizei bei einer Drogenrazzia in Dhaka
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman

একটু পেছন ফিরে দেখা যাক৷ সেই সাদা-কালো ছবির যুগে,  যখন দৈনিক ইত্তেফাকের পাতাজুড়ে বড় বড় ছবিসহ ছাপা হতো সিনেমার বিজ্ঞাপন৷  অলস দুপুরে ভাত খাওয়ার পর অন্যতম বিনোদন ছিল রেডিওটা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে সিনেমার বিজ্ঞাপন শোনা৷ চিত্রালী, পূর্বাণীর পাতা কেটে মানুষ ঘর সাজাতো৷ বেতারে ভেসে বেড়াতো মাজহারুল ইসলাম, নাজমুল হুসাইনের কণ্ঠ, ‘হ্যাঁ ভাই আসিতেছে, রূপালী পর্দায়…সেই সময়ও বাণিজ্যিক সিনেমাতে ছিল পুলিশের আবশ্যিক উপস্থিতি৷ তবে সেটা শুধু শেষ দৃশ্যে৷ পুরো সিনেমাজুড়ে নির্যাতিত নায়ক শেষ অঙ্কে এসে ভিলেনকে তুলোধুনো করে দর্শকদের ‘পয়সা উসুল' করছেন, ঠিক সেই সময় বেরসিক পুলিশের আগমন, ‘‘হ্যান্ডস আপ...আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না….৷''

সিনেমায় শেষ দৃশ্যে পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেলেও আমরা নিশ্চিতভাবেই জানতাম, শুধু শেষ দৃশ্যেই নয়, বাস্তব ক্ষেত্রে পুলিশ হাজির হতে পারে যে কোনো দৃশ্যে, যে কোনো সময়৷ সাম্প্রতিক সময়ে এটা আরো প্রবলভাবে উপলব্ধি করতে হচ্ছে। এই শেষ সময়ের উপস্থিতি আর গৎবাঁধা ডায়লগের চক্কর থেকে পুলিশ বের হয়ে এসেছে সেই কবেই৷ এখন তাদের নিয়ে রীতিমতো সিনেমা তৈরি হয়, পুলিশের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা কিংবা তাদের ইমেজ রক্ষায় নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ৷

‘নবাব এলএলবি' ছবির পরিচালক অনন্য মামুন আর অভিনেতা শাহীন মৃধা ‘পর্নোগ্রাফি মামলায়' কারগারে৷ ঘটনাটি ইতোমধ্যে সবার জানা হয়ে গেছে৷ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বের সাথে প্রকাশ পেয়েছে খবরটি৷ আর তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে উল্লেখিত চলচ্চিত্রের সেই ‘বিশেষ' অংশটুকু৷

পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২-তে পর্নোগ্রাফির যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তাতে ‘‘যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যাহা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যাহার কোনো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই৷''এমন কন্টেন্টকে পর্নোগ্রাফি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷

‘নবাব এলএলবি' চলচ্চিত্রটির ওই অংশের সংলাপগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে৷ সেগুলো আপত্তিকর এবং কুরুচিপূর্ণ বলে মনে করাটা দোষের নয়৷ তবে সেটাকে পর্নোগ্রাফির আওতায় ফেলা হবে কিনা, সেই বিবেচনা কে করবে? কিংবা এর ‘শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য' রয়েছে কিনা সেটাই বা নির্ধারণ করবে কে? একটি চলচ্চিত্র মুক্তির আগে সেটি নানা ধাপ পেরোতে হয়৷ চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ড রয়েছে এসব দেখভালের জন্য৷ এর বাইরে কেউ সংক্ষুব্ধ হতেই পারেন, আর সেই ক্ষোভ বা অভিযোগ প্রকাশের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাও রয়েছে নিশ্চয়ই৷

প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো সিনেমার দৃশ্য অশ্লীল মনে হলে তার প্রতিকার কী? ধরে ধরে পরিচালক আর অভিনেতা-অভিনেত্রীকে জেলে পুরে দেয়া? এই ছবিটি ছাড়া অন্য কোনো সিনেমায় অন্য কোনো পেশা বা চরিত্রের মানুষকে নিয়ে কী কখনোই ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ বা আপত্তিকর দৃশ্যের চিত্রায়ন হয়নি? সেসব ক্ষেত্রে কী দেখেছি আমরা? কখনো সেই ‘আপত্তিকর' অংশটি ছেটে ফেলা হয়েছে, আবার কখনো চলচ্চিত্রের প্রদর্শনেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে৷

কথায় বলে, বাঘে ছুলে আঠারো ঘা, আর পুলিশ ছুলে ছত্রিশ….সেই বাক্যটি স্বার্থকতা প্রমাণেই সম্ভবত নবাব এলএলবি ছবির পরিচালক আর অভিনেতাকে জেলে পুরেছে পুলিশ৷ অন্য কোনো পেশার মানুষকে খল দেখানো এক জিনিস, আর পুলিশকে ভিলেন সাজানো অন্য বিষয়৷ এটি হাড়ে হাড়ে এখন টের পাচ্ছেন অনন্য মামুন আর শাহীন মৃধা৷

তবে পুলিশের নানামুখী কর্মকাণ্ড শুধু চলচ্চিত্রের মান এবং মননশীলতা রক্ষায় সীমাবদ্ধ নেই৷ ‘জনগনের বন্ধু' হওয়ার তীব্র অভিপ্রায় নিয়ে পুলিশ বাহিনী এখন তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও শুদ্ধতা রক্ষা, জীবনাচারণ এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা কিংবা সামাজিক অবক্ষয়রোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে৷

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইয়ের কন্টেন্ট কী থাকবে, সেটা নিয়েও মাথা ঘামাতে দেখা গেছে পুলিশকে৷ ঘটনাটি ২০১৭ সালের৷ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সে বছর বইমেলা শুরুর আগে এর নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক নিয়ে এক বৈঠক হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তরে৷ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন বিতর্কিত বই প্রকাশ হওয়ার আগেই তা রোধ করতে পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ করবে৷ মানে, পুলিশ ও গোয়েন্দারা বই পড়ে দেখবে ও প্রয়োজনে কোনো বইয়ের প্রকাশ তারা ‘রোধ' করবে৷ কীভাবে এই কাজটি তারা করবে তার একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তা৷ তিনি বলেন, বাংলা একাডেমি থেকে একটি প্যানেল হবে৷ আর পুলিশের বিশেষ শাখা একটি দল তৈরি করবে৷ এই দলটি ‘বিশেষ ঘরানার' কিছু লেখকের বই পড়ে সিদ্ধান্ত জানাবে৷ এর সরল অর্থ হচ্ছে, বই বাজারে আসা বা না আসার বিষয়টি পুলিশের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে৷ তবে বইমেলায় বই আসার আগে পুলিশের এই ‘বই পড়া' নিয়ে আপত্তি ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন লেখক, পাঠক এবং প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্টরা৷

এ তো গেল বই পাঠ, এর বাইরে সম্প্রতি সমাজ সংস্কারক হিসেবে পুলিশের আবির্ভাবেও শঙ্কিত হয়ে পড়েছে মানুষ৷ পরপর কয়েকটি ঘটনা সাধারণের মনে এই শঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে৷

এটি একেবারেই সাম্প্রতিক ঘটনা৷ একজন নারী চিকিৎসক ভালোবেসে কেন একজন ‘সামান্য নাপিতের' হাত ধরে বাড়ি ছাড়লেন, সেটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা৷ তারা মনে করছেন, এটি সমাজে ‘খারাপ উদাহরণ' সৃষ্টি করতে পারে, তাই এ থেকে সমাজকে রক্ষা করতে দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ তারা৷

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, রংপুরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশসুপার মিলু মিয়া বিশ্বাসের বিশ্বাস, একজন নাপিতকে বিয়ে করে নারী চিকিৎসক অন্যায় করেছেন৷ তার মতে, স্বাধীনতা আছে বলেই কেউ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না৷ সেই চিকিৎসক নাকি শুধু পরিবার নয়, চিকিৎসক সমাজকেও লজ্জায় ফেলেছেন৷

একজন পূর্ণবয়ষ্ক মানুষ কেন এবং ‘সামাজিক মর্যাদা' অনুযায়ী কাকে বিয়ে করবেন, কার সাথে প্রেম করবেন, সেটাও নির্ধারণ করে দেবে পুলিশ! তার মানে কার কতটুকু 'স্বাধীনতা' আছে এবং কে কী করতে পারবেন তার সীমারেখাও ঠিক করে দেবে পুলিশ?

এর বাইরে আমরা দেখেছি, ‘বখাটে কাট' এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পুলিশকে জনসংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে উঠতি বয়সের ছেলেপেলেদের চুল কেটে দেয়ার মতো মহান দায়িত্ব পালন করতে৷ ঘটনাটি গত বছরের৷ গণমাধ্যম মারফত আমরা জানতে পারি, চুল ও দাড়ির ‘বখাটে কাট' বন্ধ করতে সেলুন মালিক ও নরসুন্দরদের সচেতন করার প্রচারে নেমেছে মাগুরা পুলিশ৷ মাগুরা সদর থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, এক সপ্তাহ আগে সদর থানা পুলিশ এ বিষয়ে সেলুন মালিকদের সঙ্গে সচেতনতামূলক সভা করে৷ একইসঙ্গে পুলিশ শহরে প্রচারপত্র বিলি ও মাইকিং করে৷ পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে প্রচারপত্র ও মাইকে সেলুন মালিকদের আহ্বান জানানো হয় যাতে কোনো সেলুনকর্মী কারো চুল কিম্বা দাড়ি বখাটে স্টাইলে না কাটেন৷

এছাড়া কয়েক মাস আগে উত্তরায় ‘টিকটক অপু' নামে পরিচিত এক যুবকের সবুজ রঙ্গের চুল কেটে নেয়া হয় কারাগারে৷ এর আগে বিচারক অপুর চুলের ধরন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন৷

এই ঘটনাগুলোর সময় এবং স্থান ভিন্ন হলেও এগুলো মোটেই বিচ্ছন্ন নয়৷ একটি রাষ্ট্র বা সমাজে পুলিশ যখন চারদিক থেকে প্রভাব বিস্তারে উদ্যত হয়, তখন এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক৷ প্রশ্ন হচ্ছে পুলিশ কেন এতটা ‘আগ্রাসী' হয়ে পড়ছে? বিষয়টি তো এমন নয় যে, একটি সমাজে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে কাজগুলো করার কথা, যেমন চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি-ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো একেবারে শূণ্যের কোটায় নেমে এসেছে, তাই তারা নজর দিচ্ছে সমাহ সংস্কারে৷ তাহলে?

রাষ্ট্র যখন পুলিশকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্ষমতাশীল করে তোলে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইন প্রণয়ন করে তাদের যথেচ্ছ ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া হয়, বইয়ের বিষয়বস্তু নির্ধারণ থেকে শুরু করে নানা প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে তাদের সম্পৃক্ত করা হয়, তখন এমন ঘটাই স্বাভাবিক৷

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশকে গ্রেফতারের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করবে বলে শুরু থেকেই আশংকা প্রকাশ করে আসছিলেন সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীরা৷ তাদের সেই শঙ্কা যে কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলছে আইনটি পাশ হওয়ার পর থেকেই৷

Bangladesch Golam Kibria
গোলাম কিবরিয়া, সাংবাদিকছবি: Privat

উল্লেখ্য, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রস্তাবে পরোয়ানা ছাড়া পুলিশকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল যেই ধারার অধীনে, সেই ধারায় সংসদীয় কমিটি প্রস্তাব করেছিল যে, পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা বা ব্যক্তিমালাকানাধীন ডিজিটাল ডিভাইস তল্লাশি বা জব্দ করার ক্ষেত্রে সরকারের ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমোদন প্রয়োজন হবে৷ তবে শেষমুহুর্তে মহাপরিচালকের অনুমোদন নেয়ার বিধানটি বাদ দিয়ে সংসদে পাস হয় বিলটি৷ অর্থাৎ, একজন পুলিশ অফিসারকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই সন্দেহভাজন ব্যক্তির ব্যবহার করা ডিজিটাল ডিভাইস তল্লাশি ও জব্দ করাসহ ঐ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে এই আইনে৷

গত জুনে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৬৫ মামলায় ৩৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কমপক্ষে ৩৮ জন সাংবাদিক৷ গত বছর এই আইনে ৭৩২টি মামলায় ১ হাজার ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷

এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমাদের প্রতিদিনের যাপিত জীবনটাই কাটবে শঙ্কায়, কখন কোথায় কী ভুল হয়ে যায়!