1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ

তানজিনা আক্তার
৫ ডিসেম্বর ২০১৭

দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক পুলিশ বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে৷ গুটিকয়েক পুলিশ সদস্যের নীতিভ্রষ্টতার কারণে এমন অভিযোগ পুরো পুলিশ বাহিনীর উপর এসে পড়ে৷ তবে এর পেছনে নাগরিক সমাজের ভূমিকাও কম দায়ী নয়?

https://p.dw.com/p/2oeqH
বাংলাদেশ পুলিশ
ছবি: picture-alliance/Photoshot

রাতের বেলা বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি, পথঘাট পানিতে থৈ থৈ৷ এ সময় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে সকালবেলা খিচুড়ি খাওয়ার স্বপ্ন মনে চলে আসে, তাই না? অথচ তখনও বাড়ির সামনের রাস্তায় এই দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতে অস্ত্র নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টায় থাকে পুলিশ বাহিনী৷ ঈদের দিন সকালবেলা মা বা স্ত্রীর রান্না করা সেমাই খেয়ে নতুন পাঞ্জাবি পরে ঈদ্গাহে আসেন ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই৷ এই সময়টুকু বিপদমুক্ত করতে মাঝরাত থেকে দায়িত্ব পালন করতে যায় পুলিশ৷ তাঁদের সন্তান, ভাই-বোনও খুব আশা করে থাকে একসাথে  ঈদ উদযাপনের৷ না কোনো নতুন পোশাক তাঁদের পরা হয় না৷ নামাজের ডিউটির পর মেসের বাবুর্চির রান্না করা সেমাই খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, তারপর আবারো ডিউটির তোড়জোড়৷ ঈদের ছুটিতে ফাঁকা হওয়া শহর পাহারার দায়িত্বও যে তাঁদেরই৷ হবে নাই বা কেন? এই ১৬ কোটির বেশি মানুষের দেশে পুলিশের সংখ্যা যে অপর্যাপ্ত৷ তাই ঘুরেফিরে একজনকেই হরেকরকম দায়িত্ব পালন করতে হয়৷

জুলাই ১, ২০১৬ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো দিন৷ গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় বিদেশিসহ বহু মানুষের অবরুদ্ধ হওয়ার খবর শুনে এসি রবিউল ইসলাম যখন ছুটে গিয়েছিলে,ন ওনার মনে তখন নিশ্চয়ই অনেকগুলো মানুষের জীবন বাঁচানো আর দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট না হতে দেওয়ার চিন্তাই ছিল৷ নিজের জীবন, ভবিষ্যৎ, এমনকি অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আর সন্তানের কথা তিনি ভাবেননি৷ জঙ্গিদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে

এ ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে নামাজের প্রস্তুতি চলাকালে সেখানে জঙ্গিরা হাজারো প্রাণ কেড়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ে আক্রমণের চেষ্টা চালায়৷ তাদেরও রুখে দিয়েছিল বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী৷ সেখানে প্রাণ হারিয়েছিল দু'জন পুলিশ কন্সটেবল৷ এর পরবর্তী সময়ে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বলিষ্ট ভূমিকা রেখেছে পুলিশ বাহিনী, সকল অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের প্রতিহত করে দিয়েছে তারা৷

দেশমাতৃকার জন্য পুলিশ সদস্যদের জীবনদানের শুরু মার্চ ২৬, ১৯৭১ সালের প্রথম প্রহর থেকেই, অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রতিরোধ রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকেই শুরু হয়৷

অপরাধ, অপরাধী, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ কিংবা সামগ্রিক নিরাপত্তা বিধান – কাজটা যে নামেই হোক স্বাভাবিক অবস্থায় একজন সাধারণ মানুষ যেখানে যেতে পারেন না, একজন পুলিশ কে সেখানে যেতেই হয়৷ হ্যাঁ, যাব না কেন? সরকার জনগণের টাকা থেকে আমাদের এর জন্য বেতন দিচ্ছে, রেশন দিচ্ছে, আমরা যেতে বাধ্য৷ হাজারো অপ্রীতিকর কাজ করতে হবে জেনেই তো পুলিশের চাকরিতে এসেছি৷ কিন্তু দিন শেষে আমিও যে মানুষ, আমার অভাব-অনুভূতিগুলোও যে অন্য সবার মতোই মানবিক!

পুলিশ সদস্যদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে চাকরিতে যোগদানের সময় থেকে শুরু করে চাকরিকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ তাঁদের আত্মস্থ করানো হয় ‘শান্তি, শৃঙ্খলা নিরাপত্তা প্রগতি'-ই হবে তাঁদের মূল কর্মপ্রেরণা এবং সব কিছুর মূলে থাকবে জনগণের প্রতি তাঁদের কর্তব্য নিশ্চিত করা৷ ‘পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ' – বাংলাদেশ পুলিশ বর্তমানে এই নীতিতেই বিশ্বাসী৷

পুলিশ বাহিনীর প্রধান কাজ হচ্ছে নাগরিকদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধ দমন ও অপরাধীকে বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনা৷ এই সব কাজ করতে গিয়ে পুলিশকে মাঝে মাঝে বিতর্কের মুখোমুখি হতে হচ্ছে৷ পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হচ্ছে৷ এই ধরনের সমস্যাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে গুটিকয়েক পুলিশ সদস্যের নীতিভ্রষ্টতার কারণে৷ তবে এর পেছনে নাগরিক সমাজের ভূমিকাও কি কম দায়ী নয়?

সাধারণ একজন মানুষ, পুলিশ সদস্য কিংবা অপরাধী – সবাই এই সমাজের অংশ৷ অপরাধগুলো সমাজেই সৃষ্ট, অপরাধীরা কারো না কারো আত্মীয়-পরিজনই হয়৷ জায়গা-জমি নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে/বোনে মারামারি, খুনখারাবিও হয়ে যায়৷ এমনকি সন্তান পিতা-মাতাকে নির্যাতন করতেও দ্বিধাবোধ করে না৷ ধর্ষণকারী, শিশু নির্যাতনকারীর পক্ষেও একটা দল তৈরি হয়ে যায়৷

তারপর বাদি-বিবাদি দু'পক্ষই চিন্তায় নেমে যায় কীভাবে পুলিশকে নিজের অনুকূলে আনা যায়৷ তখন আর সভ্য মানুষের বিবেকবোধ কাজ করে না, নিজের সামান্য স্বার্থসিদ্ধির জন্য হেন কোনো কাজ নেই যা অধিকাংশ মানুষ করে না৷ বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করা হয়৷ আর সেই ফাঁদে আকৃষ্ট না হলে তখন হুমকিধামকি প্রদানের প্রচেষ্টাও চলে৷

আমাদের দেশের মানুষ রাস্তা-ঘাটে যেখানে খুশি পার্কিং করে, ফুটপাতগুলো দিয়ে মটর সাইকেল চালায়, যানবাহন চলাচলের কোন নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে চায় না, কারণে-অকারণে রাস্তার উপরই মিছিল-মিটিং শুরু করে; ফলশ্রুতিতে আমাদের শহরগুলোতে নির্বিঘ্নে চলাচল দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন৷

নিজেদের তৈরি সমস্যা গুলো না দেখে ‘ট্রাফিক পুলিশ'-এর উপর পুরো দোষারোপ করা হয় অবলীলায়৷ তাঁদের কষ্টটা আর কেউ দেখতে চায় না! কেবল এক বিজয় সরণীর মোড়ে যে পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে থাকেন, ডিউটি শেষ করতে করতে যে পরিমাণ গাড়ির ধোঁয়া আর হর্নের শব্দ তাণকে হজম করতে হয় আর এতে তাঁর যে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হয়, তা অবশ্যই অর্থ দিয়ে পরিমাপের অযোগ্য৷

তানজিনা আক্তার
তানজিনা আক্তার, সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপারছবি: privat

তবে ষড় রিপুর প্রলোভনে কিছু সংখ্যক পুলিশ সদস্যও পড়ে যান৷ তারা ভুলে যান চাকুরিতে যোগদানের মৌলিক প্রশিক্ষণের সমাপনী দিনে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে কখনো নীতিভ্রষ্ট না হওয়ার শপথ নিয়েছিলেন৷ এই শ্রেণির কয়েকজন বাহিনীর সম্মানের কথা ভুলে যান, নিজের নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন৷ তাদের কারণে অনেকক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ পুলিশের সাহায্য নিতে ভয় পায়৷ জনমনে পুলিশ সম্পর্কে বিরূপ ধারণার অবতারণা হয়৷ আপামর জনতা পুলিশকে বন্ধু হিসেবে বিপদে-আপদে পাশে পাওয়ার কথা ভুলে যায়৷

কতিপয় সদস্যের দুষ্কৃতির কারণে প্রায় দু'লক্ষ সদস্যের পুলিশ বাহিনীকে অভিযুক্ত করা যায় না৷ ব্যক্তি পুলিশকে তার অপকর্মের দায় নিজেকেই বহন করতে হবে৷ নিজের লাভের জন্য যে একটা দেশের প্রধান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব সবার৷ বিপরীতে এমন অনেক পুলিশ সদস্যও আছেন, যাঁরা সরকারি টাকার অপচয় করে এক কাপ চাও খান না৷ দুর্নীতির তো প্রশ্নই আসে না৷

বর্তমান সময়ে পুলিশ প্রশাসন সদস্যদের দুর্নীতির বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স' নীতিতে বিশ্বাসী৷ কারো বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের অনৈতিক অভিযোগ পাওয়া গেলে সাথে সাথে জানানোর জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে গঠন করা হয়েছে ‘আইজিপি কমপ্লেইন সেল'৷ একজন অতিরিক্ত ডিআইজির অধীনে এই সেল ২৪/৭ ঘণ্টাই চালু থাকে৷ মোবাইল নাম্বার: +৮৮০১৭৬৯৬৯৩৫৩৫ এবং +৮৮০১৭৬৯৬৯৩৫৩৬-এ কল দিয়ে সরাসরি অথবা complain@police.gov.bd-তে মেইল করে এবং ডাক যোগেও অভিযোগ দায়ের করা যাবে৷

থানা পর্যায়ে সেবার মান বাড়ানোর জন্য এবং তত্ত্বাবধান আরো জোরদার করার জন্য বড় ‘সার্কেল (পুলিশ ইউনিট)'-গুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাগণকে পদায়ন করা হচ্ছে৷ থানা পর্যায়ে সহকারী পুলিশ সুপারদের পদায়নের পরিকল্পনা চলছে৷ ইতোমধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কয়েকটি থানায় এর পরীক্ষামূলক বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে৷ ‘ডিসিপ্লিন এবং প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড সেল'-এর মাধ্যমে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যদের আচার-আচরণ, কার্যকলাপ মনিটরিং করা হচ্ছে৷

প্রত্যেকটি পুলিশ ইউনিটে অভ্যন্তরীণভাবে সদস্যদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য নিজস্ব গোয়েন্দা টিম রয়েছে৷ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় সব পুলিশ ইউনিটেরই অফিসিয়াল ‘ফেসবুক পেজ' রয়েছে৷ সেখানে সবকটা ইউনিটের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মোবাইল নাম্বারসহ ‘মোবাইল অ্যাপস' রয়েছে৷ এগুলোর মাধ্যমে যে কোনো সময় যে কেউ সংশ্লিষ্ট পুলিশ ইউনিটকে তার সমস্যা বা অভিযোগ জানাতে পারেন৷ পুলিশ-জনগণ সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য মহল্লায় মহল্লায় ‘কমিউনিটি পুলিশিং', ‘বিট পুলিশিং' কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে৷ অনলাইন জিডি, ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারসহ বিভিন্ন যুগোপযোগী কার্যক্রম চালু করা হয়েছে৷ সদস্যদের আধুনিক পেশাগত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সকল শ্রেণির মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার এবং পেশাগত মূল্যবোধে দৃঢ় থাকতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে৷

সেবাধর্মী বাহিনী হিসেবে সেবার মান বৃদ্ধি, দুর্নীতি প্রতিরোধ, জনগণের আস্থা অর্জনে পুলিশের বিভিন্ন উদ্যোগ, প্রচেষ্টা এবং আন্তরিকতা রয়েছে৷ এখন বাকিটুকুর জন্য জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে৷ বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সব কিছুই উন্মুক্ত৷ কোনো পুলিশ সদস্যকে দুর্নীতি করতে দেখলে ছবি তুলুন অথবা তার নাম কর্মস্থলের ঠিকানা নিন এবং উপরে উল্লিখিত যে কোনো একটা ইউনিটের কাছে পৌঁছে দিন৷ নিজের পরিচয় সম্পূর্ণ আড়ালে রেখেই আপনি কাজটি করতে পারেন৷ একটু অপেক্ষা করুন, অপরাধীর শাস্তি হবেই৷ পুলিশের কাজ সরাসরি জনগণের সাথে, জনগণের প্রয়োজনে তাই জনতা-পুলিশ একাত্ম হয়ে এগিয়ে আসলেই সব ধরনের বিতর্কের অবসান ঘটবে৷    

তাই আসুন আমাদের সোনার বাংলাদেশ গড়তে সবাই মিলেমিশে কাজ করি৷

প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো জানান আমাদের, লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য