1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‌বাঙালিত্ব কি আক্রান্ত?‌

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা
৩ জুন ২০১৯

বিদ্যাসাগর, রামমোহন, যাঁরা বাঙালির তথা ভারতের নবজাগরণের আইকন, তাঁদের খাটো করার একটা সচেতন চেষ্টা কি চলছে?‌ যেভাবে চেষ্টা হচ্ছে বাংলা–সহ দেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে গুরুত্বহীন করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার?‌

https://p.dw.com/p/3Jg8C
Bangladesch The Ekushey Book Fair
ছবি: DW/M. Mamun

সারা ভারতজুড়েই প্রতিবাদ শুরু হয়েছে কেন্দ্রের দ্বিতীয় মোদি সরকারের প্রস্তাবিত শিক্ষা সংস্কার নিয়ে, যেখানে হিন্দি ভাষা শেখা স্কুল–কলেজে বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ এসেছে দক্ষিণ ভারতের  রাজ্য তামিলনাড়ু থেকে। নিজেদের ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে দারুণ গর্বিত তামিলেরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব খর্ব করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টা তারা সর্বশক্তি দিয়ে রুখবে। প্রয়োজনে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে, কিন্তু সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলবে না। বাংলায় এই প্রতিবাদের সুর এখনও চড়া নয়। যদিও সংবাদ মাধ্যমের প্রশ্নে বিশিষ্টজনেরা, কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীরা উদ্বেগ জানিয়েছেন। সোশাল মিডিয়া সরগরম করে তর্ক শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই ঈষদুষ্ণ প্রতিক্রিয়া দেখে একটা অন্য প্রশ্নও উঠে আসছে। বাঙালি কি শেষ পর্যন্ত এই দুয়োরানি সুলভ ব্যবহার পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেল, যেখানে কোন ভাষায় কথা বলতে হবে, সেটা তার কাছে আর বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে না?‌

মাত্র কদিন আগেই সমাজ সংস্কারক, ভারতীয় নবজাগরণের পুরোধা রাজা রামমোহন রায়–কে নিয়ে কটাক্ষে ভরেছে টুইটার–সহ সোশাল মিডিয়া। তার আগে ঠিক যা হয়েছে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে। বিদ্যাসাগর বিধবা–বিবাহ চালু করে, নারীশিক্ষার প্রবর্তন করে আদতে সনাতন হিন্দু ভারতীয় সংস্কৃতিকে হেয় করেছেন, এই ছিল সমালোচকদের বক্তব্য। ঠিক একই কথা বলা শুরু হয়েছে রাজা রামমোহন রায়ের বিরুদ্ধেও। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করে তিনি নাকি সেই সনাতন হিন্দুয়ানির অসম্মান করেছিলেন যার পুরোটাই ছিল ব্রিটিশ শাসকদের পদলেহন করে তাদের তুষ্ট রাখার উদ্দেশ্যে। সমাজের ভাল করার কোনও শুভেচ্ছা তার মধ্যে ছিল না। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, বিদ্যাসাগর, বা রামমোহন যখন এভাবে সমালোচিত হচ্ছেন, সায় জানানোর, বাহবা দেওয়ার লোকও ঠিক জুটে যাচ্ছে। জুটছে বাঙালিদের মধ্যেই। তবে কি বাঙালি সত্যিই এক আত্মবিস্মৃত জাত হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে ছাড়ল?‌ 

বাংলা বলে আলাদা কিছু নেই, বাঙালিরাও আঘাত করেছে: ড.পবিত্র সরকার

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড.পবিত্র সরকার এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলে–কে বললেন,'"‌সাধারণ মানুষ রামমোহনকে নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় বলে মনে হয় না। তবে নিজেদের বুদ্ধি দিয়েই এটা প্রতিরোধ করতে হবে। সামাজিকসহ যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া তো কোনও উপায় নেই।"‌ ড. সরকার বলেন, "গান্ধীজির ওপরেও আঘাত নেমে আসছে। নাথুরাম গডসে–কে গৌরবান্বিত করা হচ্ছে। কাজেই শুধু বাংলা বলে নয়, গোটা ভারতীয় সভ্যতার ওপরেই আঘাত। ভারতীয় ঐতিহ্যের ওপর আঘাত। বাংলা বলে আলাদা কিছু নেই। বাঙালিরাও অনেক সময় আঘাত করেছে।"‌

আর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা হচ্ছে, সে ব্যাপারে পবিত্র সরকারের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকারের কমিটি স্কুলে হিন্দি শেখা বাধ্যতামূলক করার যে প্রস্তাব করেছে, সেটা ছাত্র–ছাত্রীদের পক্ষে ভাল হবে না। এমনিতেই তাদের পড়াশোনার চাপ এখন অনেক বেশি। তার ওপর বাড়তি বোঝা চাপানোর চেষ্টা না করাই উচিত বলে তাঁর অভিমত।

অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং চালিকাশক্তি যার হাতে, তার ভাষাই সবার ভাষা :অভীক সরকার

এই হিন্দি–বাংলা বিতর্ক নিয়ে সোশাল মিডিয়া জুড়ে এখন বিস্তর তর্ক–বিতর্ক চলছে। সেখানে  আলাদা এক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টা দেখছেন এক বহুজাতিক সংস্থার বিপণন বিভাগের কর্মী এবং বাংলা প্রকাশনায় এক নবীন বাণিজ্য–উদ্যোগী অভীক সরকার। তাঁর সোজাসাপ্টা যুক্তি— অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং চালিকাশক্তি যার হাতে থাকে, তার ভাষাই শেষ পর্যন্ত সবার ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই বাঙালিকে যদি নিজের ভাষার জোর প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তা হলে আগে নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে, শিল্পে–বাণিজ্যে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে।

কিন্তু বাঙালি কোনওকালেই খুব ব্যবসায়ী জাত বলে পরিচিত নয়। তারা যথেষ্ট চালাক নয়, হিসাবনিকাশেও দড় নয়। তা হলে কি, অন্তত নিজের রাজ্যে নিজের ভাষাকে মান্যতা দিতে হলে বাঙালিকে তার শ্রেণিচরিত্র বদলে ফেলতে হবে?‌ ডয়চে ভেলের এই প্রশ্নের উত্তরে অভীক জানাচ্ছেন, "‌যে জাতির সবচেয়ে বেশি অর্থ আছে, এখনকার বিশ্বে, সেই জাতি লেখাপড়ায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকে। যতদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, ততদিন অবধি পৃথিবীর সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজ। কিন্তু‌ যেদিন থেকে মার্কিন অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেদিন থেকে পৃথিবীর সেরা ইউনিভার্সিটি হচ্ছে হার্ভার্ড আর এমআইটি।"

অভীকের সোজা যুক্তি, লক্ষ্মীর সঙ্গে সরস্বতীর আদতে কোনও বিরোধ নেই। সমাজের কাছে বাড়তি টাকা থাকলে আর সেই অর্থ  শিক্ষায় বিনিয়োগ হলেই কেবল উৎকর্ষ আসতে পারে। সেই নিরিখে, যতদিন বাঙালির হাতে অর্থ ছিল, যতদিন বাঙালি রাজত্ব করেছে, বা অন্তত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিল, ততদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সেরা ছিল। এখন আর নয়।

আর বাঙালির সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার জন্য চালাক–চতুর হওয়ার প্রশ্নে অভীকের বক্তব্য, "চালাক–চতুর হওয়া ব্যবসার একটা বড় শর্ত, একমাত্র শর্ত নয়। ব্যবসায়ী হওয়ার সবচেয়ে বড় শর্ত ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা, আর মাটি কামড়ে পড়ে থেকে পরিশ্রম করার সামর্থ্য৷‌" অভীক পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, "বাঙালি কি ব্যবসা করত না?‌ অবশ্যই করত। ‘‌কার অ্যান্ড টেগোর কম্পানি'‌ কার?‌ ‘‌বেঙ্গল ব্যাঙ্ক'‌ কার?‌ সব আমাদের, বাঙালিদের তৈরি করা।"

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিদ্যাসাগর, রামমোহনের অসম্মান, তাঁদের অবদানকে ছোট করে দেখানোই হোক, বা বাংলা ভাষাকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া— সব কিছুই হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট নকশা মেনে। রাজা রামমোহন রায় শুধু সমাজ সংস্কারকই ছিলেন না, তিনি অত্যন্ত সফল এবং বিত্তবান একজন ব্যবসায়ীও ছিলেন। অথচ তাঁর সেই সাফল্য সম্পর্কে এখন সোশাল মিডিয়ায় কটাক্ষ ছড়ানো হচ্ছে, রামমোহন ব্রিটিশদের চাটুকারিতা করে বাণিজ্যে সফল হয়েছিলেন। হিন্দু প্রথা এবং ঐতিহ্যের বিরুদ্ধাচরণ ছিল সেই চাটুকারিতারই অংশ। আর বাঙালিদের একাংশ এই প্রপাগান্ডায় সোৎসাহে সায় জানাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আঞ্চলিক ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে গুরুত্বহীন করে তোলার বৃহৎ পরিকল্পনার অন্তর্নিহিত বিপদটা অনেকেই সম্ভবত বুঝতে পারছে না।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান