1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিদায়! সব মানুষের পেলে!!

৩০ ডিসেম্বর ২০২২

কিছু মানুষ সব কিছুর সংজ্ঞা বদলে দেন৷ তাদের ছোঁয়ায় বদলে যায় সব৷ বদলে যায় মানুষের মন৷ সবকিছু কেমন যেন হয়ে যায়৷

https://p.dw.com/p/4La2G
পেলে
ইটালির কবি পিয়ের পাওলো পাসোলিনির সব সময় মনে হতো, ‘‘পেলের পায়ে বল এলে ফুটবল খেলাটা কবিতা হয়ে যেতো!’’ছবি: Kirsty Wigglesworth/AP/picture alliance´

সেই ঘোর লাগা এক মুহূর্তে একজন জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘আপনি পেলে বানান লিখেন কিভাবে?’’ জবাব এলো, ‘‘G-O-D!’’ সেই ‘ঈশ্বর’ গতকাল মারা গেছেন! ‘ঈশ্বর’ কখনো মারা যান নাকি!

পেলেকে প্রকাশ্যে, জোর গলায় প্রথম ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছিলেন প্যাট ক্রেরান্ড৷ যেখানে-সেখানে নয়, একেবারে বিশ্বকাপের আসরে৷ প্যাটের কথা হেসে উড়িয়ে দেবেন এমন মানুষ ফুটবল দুনিয়ায় একজনও ছিল না তখন৷ ম্যানইউ-র অনেক সাফল্যের নায়ক তখন ১৯৭০ বিশ্বকাপের তারকা ধারাভাষ্যকার৷ টেলিভিশনের বিশ্বজয় তখনো অনেক দূর-কি-বাত৷ তখনো দুনিয়ার ৯০ ভাগ মানুষ রেডিওতে কান পেতে চন্দ্রাভিযান শোনে আর দেখে৷ মাত্র বছরখানেক আগেই নিল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রেখে বলেছেন, ‘‘That's one small step for a man, but one giant leap for mankind.’’ মেক্সিকোয় তখন যেন এক মানুষের ‘giant leap’ দেখছিলেন ক্রেরান্ড৷ পেলে তখন তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের পথে!

কত মহাতারকার একখানা পেতেই জীবন যায়, কত তারকার হা-হুতাশেই কেটে যায় জীবন, সেখানে পেলে কিনা জিতে নেন তৃতীয় বিশ্বকাপ! তা-ও কি, সবাই যার গোল করার প্রশংসাতেই শুধু মুখে ফেনা তোলেন, সেই পেলে কিনা পুরো আসরে ছয়টা গোল করিয়েও বিশ্বরেকর্ড গড়েন!

পেলের এমন অবিশাস্য পারফরম্যান্সে ধারাভাষ্যকারদেরও মনে তখন বিস্ময়ের ঘোর৷ তাই টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার ম্যালকম অ্যালিসনের চটুল প্রশ্ন ‘‘How do you spell Pele?’’-র উত্তরে এলো ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ার মতো উচ্চারণ, ‘‘Easy : G-O-D.’’

দু বছর আগে পেলের ৮০তম জন্মদিনে ক্রেরান্ডের সেই অমর বাণীকে আবার স্মরণ করে ফিফাডটকম৷ সেখানে এখনো দেখা যাবে নেলসন ম্যান্ডেলার ছোট্ট করে বলা বিশাল এক কথা, ‘‘To watch him play was to watch the delight of a child combined with the extraordinary grace of a man in full.” 

ইটালির কবি পিয়ের পাওলো পাসোলিনির সব সময় মনে হতো, ‘‘The moment the ball arrived at Pele's feet, football transformed into poetry.’’ সোজা কথায় যার অর্থ, পেলের পায়ে বল এলে ফুটবল খেলাটা কবিতা হয়ে যেতো!

তো সেই কবিতাকে ছিঁড়ে, কেটেকুটে ধ্বংস করার ইচ্ছে নিয়ে মাঠে নামতেন অনেকেই৷ এবং ১৯৭০ বিশ্বকাপের আগে লাল কার্ড-হলুদ কার্ড বলতে কিছু ছিল না বলে তাদের ঠেকানোর কোনো উপায়ও ছিল না৷ সে কারণে ১৯৬৬-র আসরে সতীর্থদের কাঁধে ভর করে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল পেলেকে, তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ডে যাওয়া ব্রাজিলকে বিদায় নিতে হয়েছিল আগেভাগে৷

পেলে ৩০ বছর বয়সে ব্রাজিলকে তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন নিজে চার গোল করে এবং অন্যদের দিয়ে ছয় গোল করিয়ে
পেলে ৩০ বছর বয়সে ব্রাজিলকে তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন নিজে চার গোল করে এবং অন্যদের দিয়ে ছয় গোল করিয়েছবি: AP

তো মেক্সিকোয় ডিফেন্ডারদের ‘গুন্ডামি’ ঠেকানোর দাওয়াই লাল-হলুদ কার্ড আসায় পেলে যেন নিজেকে মেলে ধরার মোক্ষম সুযোগটা পেলেন৷ শিল্পীর হাত খোলা থাকলে, মন ফুরফুরে থাকলে, হাতে রং-তুলি এলে ক্যানভাসে যা হয়, মেক্সিকোর মাঠে মাঠে যেন তা-ই হলো৷ ৩০ বছর বয়সে তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগটা দুর্দান্তভাবে কাজেও লাগালেন নিজে চার গোল করে এবং অন্যদের দিয়ে ছয় গোল করিয়ে৷  

এমন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার গল্পটাও ধরে রেখেছে তার্চিসিও বুর্গনিচের একটি উক্তি৷ ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হারার পর ইটালির ডিফেন্ডার বলেছিলেন, ‘‘ম্যাচ শুরুর আগে আমি নিজেকে বলেছিলাম, ওর শরীর তো অন্য সবার মতো চামড়া আর হাড্ডি দিয়েই তৈরি (সুতরাং ওকে আটকানো কোনো ব্যাপার না), কিন্তু আমি আসলে ভুল ভেবেছিলাম৷’’

এডসন আরান্তেস ডো নাসিমেন্তো পেলের খেলা যারা দেখেছেন তাদের অনেকের কাছেই তিনি শুধু  রক্ত-মাংসের মানুষ বা একটা চর্মগোলকে লাথি মারার কসরত খেটেখুটে দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে হারানোয় আনন্দ খোঁজা নিছক  ফুটবলার নন, পেলে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু৷

দরিদ্র বাবা বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনকে স্মরণে রেখে ছেলের নাম রেখেছিলেন এডসন আরান্তেস ডো নাসিমেন্তো৷ পেলে কিন্তু বাবার দেয়া নাম নয়! লোকে ভালোবেসে ডাকে এই নামে৷ গরিবের সংসারের সবার মুখে আহার তুলতে ছেলে তার বিজ্ঞানী হবে কি, বয়স ছয়-সাতেই কখনো রেস্তোরাঁয় কাজ করে,কখনো বুট পালিশ করে দু পয়সা ঘরে আনে৷

দক্ষিণ অ্যামেরিকার প্রতিটি ফুটবল-পাগল পরিবারের কর্তার মতো পেলের বাবা দোনাদিনিয়োও ফুটবল খুব ভালোবাসতেন৷ ১৯৫০-এ নিজের দেশে প্রায় হাতে আসা প্রথম বিশ্বকাপটা যখন উরুগুয়ের হাতে তুলে দিলো ব্রাজিল, দোনাদিনিয়ো লুকিয়ে কাঁদছিলেন৷ এডসনের বয়স সবে নয় পেরিয়েছে তখন৷ বাবার কাছে জানতে চাইলো, ‘‘কী হয়েছে?’’

বাবা অশ্রু মোছেন, সংকোচে মুখ লুকান৷

এডসন সান্ত্বণা দেয়, ‘‘তুমি ভেবো না, বাবা, আমি একদিন ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতাবো৷’’

‘‘কী ছেলেমানুষ, বুট পালিশ করে জীবন কাটে যার, যার মুখে তিন বেলা খাবার ওঠে না, যাকে একজোড়া বুট কিনে দিতে পারি না, সেই ছেলে বলে কিনা আমাকে বিশ্বকাপ জিতে দেখাবে!’’

পেলের কথা বিশ্বাস না করে বাবাও ভুল করেছিলেন৷ মাত্র আট বছর পর পেলে কিন্তু ঠিকই কথা রেখেছিলেন সবচেয়ে কমবয়সি হিসেবে বেশ কিছু রেকর্ড গড়ে দেশকে প্রথম বিশ্বকাপ জিতিয়ে৷

সেই রেকর্ড হয়ত ভাঙবে৷ তার তিনবার বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ডও হয়ত বর্তমান বা অনাগত পৃথিবীর কারো দখলে যাবে কোনোদিন৷ তাতে পেলের আসন একটুও টলবে না৷

আশীষ চক্রবর্ত্তী, ডয়চে ভেলে
আশীষ চক্রবর্ত্তী, ডয়চে ভেলেছবি: DW/T. Mehedi

কেউ প্রশ্ন তুললেই কেউ-না-কেউ মনে করিয়ে দেবেন ফেরেঙ্ক পুসকাসের সেই মন্তব্য, ‘‘ইতিহাসের সেরা ফুটবলার নিশ্চয়ই ডি স্টেফানো৷ হ্যাঁ, পেলেকে আমি খেলোয়াড় হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করতেই রাজি নই, কারণ, তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে৷’’

যাকে ছাড়া আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ হয়ত ১৯৭৮ সালে আসতো না, সেই কোচ সিজার লুই মেনোত্তি বলতেন, ‘‘আমার দেখা ফুটবলারদের মধ্যে পেলেই সেরা৷’’ কারণ, পেলে, ‘‘Fast, agile, physically terrible, header like no other, dominated the ball in the air, hit it with both legs, it was beautiful, you couldn't hit it because you had to bear it after.’’

ক্যান্সারে ভুগে পেলে ৮২ বছর বয়সে অনন্তে যাত্রা করলেও আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দলের কোচ মেনোত্তি এখন তার দেশের তৃতীয় বিশ্বকাপ সাফল্যের আনন্দ উপভোগ করছেন৷ তবে পেলের প্রয়াণে তার মাথার ওপরের আকাশটাও নিশ্চয়ই বিষন্ন৷ তার হয়ত পেলে আর ম্যারাডোনাকে একসঙ্গেই মনে পড়ছে আজ৷

ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবর শুনে শোকাহত পেলে বলেছিলেন, ‘‘One day, I hope we can play soccer together in the sky.’’ ২৯ ডিসেম্বর ২০২২-এ সেই অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে৷ ফুটবলের দুই মহান শিল্পীর একসঙ্গে আকাশ-মাঠে নামায় আর তাই বাধা নেই৷

নিউইয়র্ক কসমস আর সান্তোসের প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে পেলে যেদিন মর্ত্যের ফুটবল মাঠকে বিদায় জানিয়েছিলেন, ব্রাজিলের এক পত্রিকা শিরোনামে লিখেছিল, ‘‘Even the sky was crying.’’ পেলে আর ফুটবল খেলবেন না বলে এমনকি আকাশটাও নাকি সেদিন কাঁদছিল৷ পৃথিবীর অনেকটা আকাশ আজও কাঁদছে৷ ওদিকে কে জানে, পেলে আর ম্যারাডোনা হয়ত আকাশ-মাঠে চুটিয়ে ফুটবল খেলছেন!