1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিপন্ন ভাষার সাহসী সৈনিকদের কথা

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

পৃথিবী জুড়ে নানা জাতি, নানা ভাষা৷ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বৃহতের চাপে তাদের ভাষাকে হারিয়ে ফেলছে৷ পশ্চিমবঙ্গের উত্তর সীমায় টোটো উপজাতির অস্তিত্ব বহুকাল সঙ্কটে৷ জাতির আগে মৃত্যুর মুখে তাঁদের ভাষা৷

https://p.dw.com/p/2t8fr
ছবি: DW/P.Samanta

প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলেই ভাষার জন্য বেদনা জেগে ওঠে৷ বিশেষত সেইসব ভাষার জন্য, যেগুলি কালের নিয়মে লুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে৷ একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের ৪৮ ঘণ্টা আগে ইউনেস্কো যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে সেই আশঙ্কার কথা আরও একবার উঠে এসেছে৷ রাষ্ট্রপুঞ্জের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক এই সংস্থার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যে ভাষা ১০ হাজারের কম মানুষের মাতৃভাষা, সেটি বিপন্ন হয়ে পড়েছে৷ ১৯৭১ সালের আদমশুমারির পর ভারত সরকার ঘোষণা করে, ১০ হাজারের কম মানুষের মাতৃভাষাকে সরকারি ভাষার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দরকার নেই৷ সেই ভা্ষাগুলিই আজ বিপন্ন হয়ে পড়ছে৷

ইউনেস্কোর রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ৪২টির বেশি ভাষা অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে৷ এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র ভাষা টোটো৷ বাংলার উত্তরসীমায়, ভুটান লাগোয়া নবগঠিত আলিপুরদুয়ার জেলার টোটোপাড়ায় এই ক্ষুদ্র জনজাতির বাস৷ তাঁদের জনসংখ্যা ২ হাজারেরও কম৷ এই সংখ্যাই বলে দেয়, টোটো ভাষা কতটা বিপন্ন৷ জনসংখ্যা এর থেকে আরও বেশি হলেও অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে অন্য অনেক ভাষা৷ গবেষক গণেশ ডেভি ২০১০ সালে সমীক্ষা চালানোর সময় এমন ৬০০টি ভাষা খুঁজে পেয়েছিলেন, যেগুলি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে৷ এই ভাষাগুলির অস্তিত্বই কার্যত নেই৷ তাই ১৯৯১ ও ২০০১ সালে হওয়া আদমশুমারিতে মাত্র ১২২টি ভাষার কথা বলা হয়েছে৷ আদতে ভারতে ভাষার সংখ্যা তার থেকে অনেক অনেক বেশি৷

‘‘যে ভাষা ব্যবহারিক নয়, সেই ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে’’

কেন এই বিপন্নতা? বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক ড. ইন্দ্রনীল আচার্য ২০০৯ সাল থেকে হারিয়ে যাওয়া ভাষা নিয়ে গবেষণা করছেন৷ ক্ষেত্রসমীক্ষা করে এমন অনেক ভাষার কথা তাঁরা তুলে এনেছেন, যেখানে শুধুই হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা৷ অধ্যাপক ইন্দ্রনীল আচার্য বলেন, ‘‘যে ভাষা ব্যবহারিক নয়, সেই ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে৷ আমরা গ্রামে গিয়ে দেখেছি, প্রবীণ মানুষেরা এখনও মাতৃভাষায় কথা বলেন৷ কিন্তু, নতুন প্রজন্ম মাতৃভাষায় কথা বলার আগ্রহ হারাচ্ছে, কারণ, তরুণরা দেখছেন তাঁদের ব্যবহারিক জীবন অর্থাৎ চাকরির ক্ষেত্রে এই ভাষার কোনও উপযোগিতা নেই৷ তাই একটা সময়ের পর জনজাতি টিকে থাকলেও তাঁদের ভাষাটা হারিয়ে যাচ্ছে৷’’

টোটো ভাষা লুপ্ত হওয়ার পিছনে একই কারণ৷ সে কথা বলছেন টোটো সমাজের প্রতিনিধিরাই৷ শুধু নেপালি বা বাংলার আগ্রাসন নয়, টোটোপাড়ায় অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের মিশ্রণও টোটোর অস্তিত্বে থাবা বসিয়েছে৷ তবে, এই ছবি শুধু প্রত্যন্ত টোটোপাড়ার নয়, খোদ কলকাতায় তার নমুনা মিলবে ভূরিভূরি৷ দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দা বছর তেইশের ভারতী সর্দার বাঙালি হলেও বাংলার তুলনায় হিন্দিতেই স্বচ্ছন্দ৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে আমার এলাকায় হিন্দিতেই বেশি কথা বলতে হতো সারাদিন৷ সেই অভ্যেস রয়ে গিয়েছে৷ তাই বাংলা তেমনভাবে শিখে উঠতে পারিনি৷’’

আবার এই কলকাতাতেই ভাষা রক্ষার লড়াইয়ে নামা কয়েকজন তরুণ এসেছিলেন তাঁদের গানের রেকর্ডিং করতে৷ টোটোরা নিজেদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে গানকে অবলম্বন করেছেন৷ এই দলের নেতা সত্যজিৎ টোটো বলেন, ‘‘চোখের সামনে নিজের ভাষাকে শেষ হয়ে যেতে দেখছি৷ আমাদের ছেলেমেয়েরাই আর টোটো ভাষা বলে না৷ কেউ বাংলা বলছে, কেউ নেপালি বলছে, কেউ আবার ইংরাজিও বলছে৷ আমাদের মুখের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে৷’’

চোখের সামনে নিজের ভাষাকে শেষ হয়ে যেতে দেখছি: সত্যজিৎ টোটো

বড় ভাষা এভাবেই ছোট ভাষাকে গিলে নেয়৷ এই মাৎস্যন্যায়ই সভ্যতার নিয়ম৷ অধ্যাপক ইন্দ্রনীল আচার্যর মতে, ‘‘এ কারণেই বাংলাকে বলা হয় কিলার ল্যাঙ্গুয়েজ অর্থাৎ ঘাতক ভাষা৷ যে ভাষা অন্য ছোট ভাষাকে খেয়ে নিচ্ছে৷ বিশ্বজুড়েই এই প্রবণতা’’ একইভাবে বাংলা আবার জাতীয় স্তরে ইংরেজি ও হিন্দির দাপটে আক্রান্ত৷ এই অভিযোগ আকছার শোনা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের অভিভাবকদের একাংশ ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াতে পছন্দ করেন৷ পড়ুয়ারা বাংলা বলতে না পারলে তাঁদের মধ্যে বেদনা জাগে না৷ উল্টে নাকি সেটাকে শ্লাঘা হিসেবেই দেখা হয়৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘ঘাতক ভাষা’ বাংলার সঙ্গে টোটোর কোনও ফারাক নেই৷

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা সংক্রান্ত প্রকল্পের বর্তমান কো-অর্ডিনেটর, ইংরেজির অধ্যাপক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, পশ্চিমবঙ্গের খানদশেক ভাষা সবচেয়ে বেশি বিপন্ন৷ এর মধ্যে টোটো ছাড়াও রয়েছে ধিমাল, রাভা, বোরো, অসুর, মুণ্ডারি, লোধা, কুড়মালি ভাষা৷ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে লুপ্তপ্রায় ভাষা সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার তুলে ধরার জন্য ‘জনলিপি' নামক ওয়েবপেজ তৈরি করা হয়েছে, আগামী মাসেই যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন৷

টোটো ভাষায় একটি গান

পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা সাড়ে আট কোটির কাছাকাছি৷ অথচ বিশ্বায়নের পর ইংরেজির রমরমা আরও বাড়তে থাকায় নিজভূমে বাংলা আজ কোণঠাসা৷ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রথামাফিক আবারও বাংলা ভাষাকে রক্ষার চ্যালেঞ্জ নেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু বিশ্বায়নের জেরে যে আর্থসামাজিক পরিবর্তন হয়েছে, তাকে কে পাল্টাবে? এই সত্যটা জেনেও ভাষা রক্ষার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন সত্যজিৎরা৷ তাঁর সঙ্গে শনে, অভিষেক, মদন, বিবজিত টোটো সামিল হয়েছেন৷ শনের ভাষায়, ‘‘সত্যজিৎদাকে দেখে আমরা নিজেদের ভাষায় গান করতে নেমেছি৷ সেই কাজে সাফল্যও মিলেছে৷ আমাদের লেখা গান এখন টোটোপাড়ার অনেক স্কুলে গাওয়া হয়৷’’ গিটারবাদক অভিষেক বলেন, ‘‘আমি আগে হিন্দি গানের বেশি চর্চা করতাম৷ নিজের ভাষা বাঁচানোর জন্য এই দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি৷’’

ভাষা বাঁচাতে কেন গান গাইছেন? মাত্র ১,৫৮৫ জনের টোটো জনজাতির এক সদস্য সত্যজিৎ বলেন, ‘‘সবার বাড়ি গিয়ে ভাষা বাঁচানোর কথা বলে লাভ নেই৷ তাই ছেলেমেয়েদের নিয়ে গান করি৷ তাতে একসঙ্গে অনেকের কাছে পৌঁছানো যায়৷ কাজে লাগুক বা না লাগুক, গানের সুরেই তো ভাষাটা ছেলেমেয়েদের মুখে থাকছে৷’’ টোটোপাড়া-বল্লালগুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য রূপচাঁদ টোটো এই উদ্যোগে খুশি৷ তাঁর মতে, ‘‘এটা খুব ভালো উদ্যোগ৷ আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে৷’’