1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিশ্বকাপে তামিমবিহীন বাংলাদেশের ‘সম্মান’ থাকবে তো?

আজাদ মজুমদার
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কাজীর দেউড়ির সেই বাড়িতে কাল রাতে আলো জ্বলেছিল কিনা বলা মুশকিল। ক্রিকেট এই বাড়ির প্রতিটি সদস্যের অস্থি-মজ্জায়। জন্মেই যেখানে সবাই স্বপ্ন দেখেছেন একদিন বাংলাদেশের জার্সি গায়ে চড়াবেন।

https://p.dw.com/p/4WqUt
Tamim Iqbal
ছবি: Aijaz Rahi/AP/picture alliance

অন্তত তিনজন সেই স্বপ্নের নাগালও পেয়েছেন। একজন তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের যুগসন্ধিক্ষণে দেশকে নেতৃত্বই দিয়েছেন

বাড়ির ছোট ছেলেটির স্বপ্ন আরো অনেক বড় ছিল। ক্রিকেটের একটা বাঁক বদল তার হাত ধরেও হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতেই থেমে থাকতে চাননি। আশা ছিল, একদিন হয়তো বাংলাদেশকে বিশ্বকাপ জয়েও নেতৃত্ব দিতে পারবেন। এটাকে অতি বড় দূরাশা ভেবে কেউ কেউ চাইলে এখন উড়িয়েও দিতে পারেন। কিন্তু তাতে তো আর কিছু সত্য পুরোদমে মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে না।

একটা সময় কেবল তিনি একা নন, তাকে ঘিরে পুরো বাংলাদেশই এই স্বপ্ন দেখেছিল। মাশরাফি মুর্তজা বিদায় নেওয়ার পর তার হাতেই বাংলাদেশের ওয়ানডে দলটাকে তুলে দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। হাতে তিন বছরের বেশি সময় ছিল। সবাই আশা করেছিলেন এই সময়ে তিনি দলটাকে নতুন করে গুছিয়ে নেবেন। সেটা প্রায় করেও ফেলেছিলেন তামিম ইকবাল।

যে প্রতিযোগিতাকে এবারের বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব মনে করা হয়েছিল, সেই ওডিআই সুপার লিগে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্মরণীয় কিছু জয় পেয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে যেখানে বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব উতরাতে শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, বাংলাদেশ এই কাজটা সেরে নিয়েছে অনায়াসে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে তারা হারিয়েছে। তামিম নিজে ছিলেন না, কিন্তু তার হাতে গড়া এই দল ভারতকেও হারিয়েছে দেশের মাঠে। বাছাই পর্বটা তারা শেষ করেছে তৃতীয় হয়ে। এসব সাফল্যের পর স্বপ্ন না দেখলে সেটাই হতো বাড়াবাড়ি। কিন্তু তার স্বপ্নে আগুনের সলতে পড়েছে দুটো সিরিজে। প্রথমটি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, যেখানে হেরে যাওয়ায় বাংলাদেশের দেশের মাঠে টানা সাত বছর অপরাজিত থাকার রেকর্ডে ছেদ পড়েছে।

পরেরটি আফগানিস্তানের বিপক্ষে, যেখানে হেরে যাওয়ায় বাংলাদেশের প্রায় সবার অহমে ঘা লেগেছে। তামিম ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মোটেও ভালো খেলতে পারেননি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে হারেও অনেকে তার দায় দেখেছেন, যদিও তিনি সেই সিরিজে মাত্র একটা ম্যাচই খেলেছেন। কিন্তু তার অবসরজনিত ঘটনাপ্রবাহ পুরো দলের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিয়ে থাকবে, যার প্রভাব হয়তো খেলায় পড়ে থাকবে।

আফগানিস্তান সিরিজেই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল তামিম বিশ্বকাপে অধিনায়ক থাকছেন না। তাতে তার বিশ্বকাপ জয়ে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্নটা পুরোপুরি মরে গেলেও তিনি এবারের বিশ্বকাপে খেলেতেই পারবেন না, এমনটা বোধকরি তার ঘোরতর শত্রুও কল্পনা করেননি। তামিম নিজেও সম্ভবত এমন আশঙ্কার কথা একবারের জন্যও মাথায় আনেননি।

অবসর থেকে ফিরে আবার নতুন করে শুরু করতে তামিম দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সমর্থন পেয়েছেন। কিন্তু যাদের সমর্থন, সহযোগিতা পেলে তিনি সব আবার গুছিয়ে নিতে পারতেন, সেটা যে পাননি তা তো এখন দেখাই দেখা যাচ্ছে।

বিশ্বকাপের আগেই নিজেকে ফিট করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন তামিম। কিছুটা সফলও হয়েছেন, যার বড় প্রমাণ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম দুই ম্যাচে তার মাঠে ফিরে আসা।

ম্যাচ দুটো খেললেও ব্যাটিং তিনি আদতে এক ম্যাচেই করেছেন। তাতে আহামরি কিছু হয়তো করেনেনি, কিন্তু এমন কিছু খারাপ ব্যাটিংও করেননি। তামিম হয়তো ভেবেছিলেন এই একটা ইনিংস দিয়েই তার ফর্ম এবং ফিটনেস দুটোই প্রমাণ করা গেছে। যেমনটা করেছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। কিন্তু মানুষ যা ভাবে অনেক সময় ঘটনা ঘটে তার উল্টো। ব্যক্তিগতভাবে একটু সৎ থাকতে চেয়েই তিনি নিজের বিপদ টেনে এনেছেন।

বিশ্বকাপে সব ম্যাচ তিনি খেলতে পারবেন না- এমন একটা তথ্য নির্বাচকদের জানিয়ে দেওয়ায় যেন রীতিমতো আগুনে ঘি পড়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবাই তামিমের এই ঘোষণায় রাতারাতি পেশাদার হয়ে গেছেন। অথচ এই পেশাদাররাই কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচ দেড় ডজন খেলোয়াড়কে খেলিয়ে দিয়েছে।

বিশ্বকাপ দল ঘোষণায় দেরি হচ্ছে কেন- এই প্রশ্নে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিনকে নিয়ে সোমবার বেশ ক'জন কৌতুক করে বলেছেন, তিনি তৃতীয় ম্যাচের দল গড়েই কূল পাচ্ছেন না, বিশ্বকাপ দল কখন করবেন? অথচ এই ম্যাচটা দিয়ে বাংলাদেশ দল তাদের প্রস্তুতিটা সুন্দরভাবে শেষ করতে পারতো। সেটা তো হয়ইনি, বরং এই ম্যাচ চলাকালে মাঠের বাইরে সারাদিন একের পর এক নাটক হয়েছে।

তাতে তামিমের দায় সামান্যই। এই দায়টা বহুগুণে বেশি তাদের, যারা বিশ্বকাপ দল নিয়ে চাঁদ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে পুরো বিষয়টা হাস্যকর করে তুলেছেন। ধারণা করা যায়, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে আরেকটু বাজিয়ে দেখার জন্য তারা শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সেই দেখাও শেষও হয়ে গিয়েছিল শনিবার। তারপরও ব্যাপারটা তিন দিন ঝুলিয়ে রেখে সবাই মিলে দলে কেবল দমবন্ধ একটা পরিবেশই তৈরি করেনি, বিশ্বকাপের মতো বড় একটা আসরে খেলতে যাওয়ার আগের রাতে দলের ঘাড়ে তাজা একটা বিতর্ক চাপিয়ে দিয়েছেন।

অথচ চাইলে এই বিতর্কটা সহজেই এড়ানো যেতো। তামিম নিজেই নিজের কথা বলে দেয়ায় এর আগেও পেশাদারিত্বের দোহাই দিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। আফগানিস্তান সিরিজের কথাই ধরা যাক। সেখানে তামিম বলেছেন শতভাগ ফিট না হয়েও খেলবেন। এখন ক্রিকেটটাই এমন হয়ে গেছে সবসময় শতভাগ ফিট থাকা যে কারো জন্যই কঠিন। তবু পেশাদারিত্বের অজুহাতে এমন সব মানুষ তার সমালোচনা করেছেন যারা নিজেরাই ব্যক্তি জীবনে খুব একটা পেশাদারসুলভ আচরণ করেননি।

ব্যাপারটা এমনও ছিল না তামিমই প্রথম বাংলাদেশের হয়ে শতভাগ ফিট না হয়েও খেলতে চেয়েছেন। দলের সেরা ক্রিকেটার যিনি, সেই সাকিব আল হাসান ক'দিন আগেও বোলিং করতে পারবেন না, কেবল ব্যাটিং করবেন- এমন শর্ত দিয়ে ম্যাচ খেলেছেন। তিনি সাকিব বলেই তার শর্তে কেউ আপত্তি করেননি। সমস্যা হয়েছে কেবল তামিমের বেলায়। ক্রিকেটের একটা অংশের তাকে সেরা বলে মেনে নিতে প্রবল আপত্তি। অথচ এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সবচাইতে বেশি রান তারই। তিন ফর্ম্যাটে সেঞ্চুরিও আছে একমাত্র তারই।

আজাদ মজুমদার, ক্রীড়া সাংবাদিক
আজাদ মজুমদার, ক্রীড়া সাংবাদিকছবি: Mahmud Shanto

কবে কী করেছেন তা বিবেচনায় নিয়ে তাকে দলে রাখতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার এটা তো সত্য, একসময় ভালো খেলতেন বলে এবার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে দলে নেওয়া হয়েছে। পেশাদারিত্বেরা দোহাই দিয়ে তামিমের বাদ পড়াটাকে অনেকেই যেভাবে ন্যয্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, সেটা তাই একটু অবাক হওয়ার মতোই।

বাংলাদেশ কিন্তু সেই দল যার অধিনায়ক এশিয়া কাপের মতো বড় একটা টুর্নামেন্টের মাঝপথে দেশে ফিরে এসেছেন ব্যক্তিগত কাজে। বাংলাদেশ কিন্তু সেই দল যারা বিশ্বকাপের মাত্র সাতদিন আগে দলের জন্য টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট নিয়োগ দিয়েছে। চাইলে এরকম আরো উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা সামান্যই।

আপতাত যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে বিশ্বকাপে আবারো মেহেদি হাসান মিরাজকে ঘিরেই ‘ফাটকা‘ খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তামিম না থাকায় কাগজে-কলমে মিরাজই যে এখন দলের তৃতীয় ওপেনার। নিয়মিত যে দুই ওপেনারকে বাংলাদেশ দলে রেখেছে, সেই লিটন দাস আর তানজিম হাসান তামিমের সময়টা খুবই খারাপ যাচ্ছে।

এশিয়া কাপ থেকে শুরু করে পাঁচটি ম্যাচ খেলেছেন ‘ছোট তামিম’। তাতে সাকুল্যে রান ৩৪, গড় ৮.৫। লিটন দাস তো তার জার্সি নাম্বারের সাথে মিল রেখে হয় ১৬ রান করছেন নয়তো ১৬ বল খেলে আউট হয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বকাপের নয় ম্যাচেও এই ফর্ম অব্যাহত থাকলে নির্দ্বিধায় বলা যায় ২০০৩ সালের পর এটাই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের সবচাইতে বাজে বিশ্বকাপ।

২০০৩ প্রসঙ্গ আসায় পুরোনো একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এবার যেমন তামিম, সেবার বিশ্বকাপ স্বপ্নে ছাই পড়েছিল তার চাচা আকরাম খানের। শুরুতে বিতর্কিতভাবেই তাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু টানা হারে দল যখন বিধ্বস্ত, মাশারাফির ইনজুরিতে কোনোরকম একটা মওকা পেয়ে আকরাম খানকে দক্ষিণ আফ্রিকায় উড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল।

তারপর কেনিয়ার বিপক্ষে শেষ যে ম্যাচটি জিতে বাংলাদেশ কোনো রকমে ‘সম্মান’ বাঁচাতে চেয়েছিল, তাতে প্রাণপণ একাই লড়েছিলেন আকরাম শেষ দিকে, যদিও তিনি শেষ রক্ষা করতে পারেননি। তাতে অবশ্য একটা বিষয় প্রমাণিত হয়েছিল- বিশ্বকাপের মূল দল থেকে আকরামকে বাদ দেওয়া ছিল অনেক বড় ভুল। একইরকম পরিস্থিতিতে যদি এবার তামিমের বাদ পড়াটাও ভুল প্রামাণিত হয়, তবে ভয় হয় বাংলাদেশের জন্য আরো একটা লজ্জার বিশ্বকাপই হয়তো অপেক্ষা করছে।