1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডাকা হয় কেন?

সমীর কুমার দে ঢাকা
২১ জানুয়ারি ২০২২

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে কারণে-অকারণে পুলিশ ডেকে আনে কর্তৃপক্ষ৷ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেক যৌক্তিক আন্দোলনও পুলিশ দিয়ে দমানোর চেষ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন৷

https://p.dw.com/p/45srA
Bangladesch Studenten der Uni in Hungerstreik
ছবি: Mohammad Rafayat Haque Khan/DW

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তো পুলিশের স্থায়ী ক্যাম্পও বানানো হয়েছে৷ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কী পুলিশের উপস্থিতি অপরিহার্য?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল খালেক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম তখন মনে করতাম ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকলে ক্যাম্পাস কলুষিত হয়ে যাবে৷ কিন্তু পরবর্তীতে কিছু বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডাকতে হয়েছে৷ তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে কোন ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে না পুলিশ৷ ফলে শিক্ষার্থীদের যে কোন আন্দোলনে কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসনকে অনেক বেশি সংবেদনশীল থাকতে হয়৷ তবে পুলিশের উপস্থিতি যত কমানো যায় ততই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মঙ্গল৷''

গত রোববার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে লাঠিপেটা করে পুলিশ৷ সেখানে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করা হয়৷ এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ বাঁধে৷ এতে পাঁচ পুলিশ সদস্য, ১০ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, ১৫ জন শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন৷ পরে উল্টো ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ৷ সেই থেকে ভিসির পদত্যাগের দাবিতে একদফার আন্দোলন শুরু হয়েছে৷ আমরণ অনশন করা ১১ জন শিক্ষার্থী শুক্রবার পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে৷ 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেভাবে পুলিশ দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে তার কোন প্রয়োজন ছিল না৷ আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা সেখানে ছিলেন তারা এবং পুলিশ সদস্যেরাও খুব তাড়াতাড়ি ধৈর্য্য হারিয়েছেন৷ আমি মনে করি, সুন্দরভাবে এটার সমাধান করা যেত৷ পুলিশ দিয়ে নির্যাতন করে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো সম্ভব নয়৷ শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আমাদের আরও বেশি সংবেদনশীল হতে হবে৷''

পুলিশের উপস্থিতি যত কমানো যায় ততই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মঙ্গল: অধ্যাপক আব্দুল খালেক

শিক্ষার্থীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত বুধবার সাংবাদিকদের সামনে আসেন উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ৷ তার দাবি, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় উপাচার্যের যদি দোষ থাকে তবে সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে তাই তিনি মেনে নেবেন৷ তিনি বলেন, এ ঘটনায় দরকার হলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তদন্ত কমিটি হতে পারে৷ তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনায় আমি খুবই মর্মাহত৷ যখন তাদের দাবি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে তখনই কে বা কারা পুলিশের উপর হামলা করেছে৷ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ শিক্ষার্থীরা আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষক প্রতিনিধিরা গালিগালাজ সহ্য করেও আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছেন৷ কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করছে৷  

ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উপর বর্বরোচিত যে হামলাগুলো হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ২০০২ সালের ২৩ জুলাই ছাত্রদলের নেত্রীদের সহায়তায় মধ্যরাতে পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে ঢুকে ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করে৷ এতে ২০০ শিক্ষার্থী আহত হয়৷ 

২০১৮ সালের ৭ আগস্ট শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে পুলিশ হামলা চালায়৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীতে অবস্থিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ এই হামলা চালায়৷ ২০১৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বর্ধিত ফি বাতিল ও সান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধের দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ দফায় দফায় হামলা চালায়৷ পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে  আট সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ ও প্রায় দু'শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন৷

বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের যৌক্তিক আন্দোলনেও হামলার ঘটনা প্রায়ই ঘটে৷ এই হামলাগুলো কী বন্ধ করা সম্ভব না? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশের উপস্থিতি যত কম হবে ততই ভালো৷ এখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনেক বেশি সংবেদনশীল থাকতে হয়৷ যে কোন পরিস্থিতিতে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললে পরিস্থিতি অনেক সহজ হয়ে যায়৷ শাহাজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা ঘটেছে, সেখানে তো ভিসির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের কোন আন্দোলন ছিল না৷ তারা আন্দোলন করছিল, একটি নারী হলের প্রভোস্টের বিরুদ্ধে৷ তারা ভিসির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল৷ ভিসি কথা বললেই তো আমার মনে হয় পরিস্থিতি জটিল হতো না৷ উনি কেন পালিয়ে গেলেন? কেন কলাসপিবল গেটে তালা দেওয়া হল? কেন কথা বললেন না? এই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর আমি খুঁজে পাই না৷ আমি যখন ভিসির দায়িত্ব পালন করেছি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেক বেশি কথা বলার চেষ্টা করেছি৷''

বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ নয়, বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাম্পাসে টহল দেয়: অধ্যাপক তুলসী কুমার দাস

হঠাৎ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত হওয়ার কারণ কী? জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার কাছে দু'টি কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে৷ এক. বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ শুরু হচ্ছে৷ ভিসি সবাইকে এটা থেকে দূরে রেখেছেন৷ এতে সরকারি দলের সমর্থক শিক্ষক নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে৷ আর দুই. ভিসির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার কিছু অভিযোগও আছে৷ যা নিয়ে অনেকদিন ধরেই বিরক্ত ছিলেন প্রগতিশীল শিক্ষকেরা৷ সবকিছু মিলিয়ে অনেকদিনের ক্ষোভের প্রকাশ হয়েছে বলেই আমার মনে হয়৷''

ক্যাম্পাসে কী এমন ঘটলো যে পুলিশকে শিক্ষার্থীদের উপর বেধড়ক লাঠি চালাতে হলো? জানতে চাইলে সিলেট মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার নিশারুল আরিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘উপাচার্য যখন শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে ছাত্রী হলের প্রভোস্টকে অপসারণ করার উদ্যোগ নিয়েছেন তখনই একটি স্বার্থান্বেষী মহল ঝামেলা তৈরি করে৷ আমরা শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করি৷ কিন্তু আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে কেউ পুলিশের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশকে প্রভোক করেছে৷ একজন পুলিশ সদস্যের হাত থেকে শটগান ছিনিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা করা হয়৷ শিক্ষকেরা যখন আমাদের বললেন, উপাচার্যকে এক্ষুনি উদ্ধার করা না গেলে, যে কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে৷ তখন আমরা শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করি৷ শিক্ষকেরা যেভাবে চেয়েছেন আমরা সেভাবে ভিসিকে উদ্ধার করেছি৷''

বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সংবেদনশীল জায়গায় পুলিশ কেন এত দ্রুত ধৈর্য্য হারায়? জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আসলেই বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গা৷ অল্প বয়সের শিক্ষার্থীরা দ্রুতই উত্তেজিত হয়ে যায়৷ তাদের সেভাবেই দেখভাল করা উচিৎ৷ আমি মনে করি, শিল্প পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশের মতো পৃথকভাবে ক্যাম্পাস পুলিশও গঠন করা উচিৎ৷ এখানে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তাদের এই সংবেদনশীলতা নিয়ে অনেক বেশি প্রশিক্ষণ থাকবে৷ দ্রুতই তারা ধৈর্য্য হারাবেন না৷''

অবশ্য অধ্যাপক তুলসী কুমার দাস বলেন, ‘‘ক্যাম্পাসে পুলিশের উপস্থিতিই থাকা উচিৎ না৷ আমি বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি, সেখানে দেখেছি পুলিশ নয় একটা বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাম্পাসে টহল দেয়৷ তাদের ওয়াকিটকি থাকে৷ তাদের হাতে কোন অস্ত্র থাকে না৷ এমন একটি বাহিনী করা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আমার বিশ্বাস৷''