1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিয়ের আচার নাকি অত্যাচার?

২৭ অক্টোবর ২০২৩

সম্প্রতি হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে দেশে কিংবা প্রবাসে বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে আপনার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমার মতোই৷

https://p.dw.com/p/4Y69f
Heirat von Elita Karim (Sängerin und Journalistin aus Bangladesh)
ছবি: Privat

বর-কনের সামনে ছাতা-বর্ষাতি লাল নীল বাতি সেট করে এক দঙ্গল ফটোগ্রাফার, ভিডিওগ্রাফার৷ বর কনের চেহারা দেখা দূরে থাকুক,আপনি কেন এসেছেন কোথায় এসেছেন ভুলে যাবেন৷ এই ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফির অত্যাচারে বিয়ের যে আবশ্যিক অনুষঙ্গ কিছু ধর্মীয় রিউচুয়াল তাও নিতান্তই গৌণ হয়ে পড়ে৷

বিয়ে নারী ও পুরুষের যৌন অর্থাৎ একটি জৈবিক প্রয়োজনের সামাজিক, আইনগত ও ধর্মীয় রীতিসিদ্ধতা৷ প্রাণী জগতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই জৈবিকভাবে যৌনসত্তা স্বাভাবিক৷ কিন্তু অন্যান্য প্রাণী সভ্য নয় বলে, তাদের সামাজিক দায় নেই,সামাজিক দায়জাত মূল্যবোধ নেই৷

মানুষ সভ্যতার ধাপে ধাপে নানা মূল্যবোধ অর্জন করেছে৷ নারী পুরুষ লৈঙ্গিক পরিচয়ের উর্ধ্বে নানা সামাজিক সম্পর্কে সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করেছে৷ এর কোনটা শ্রদ্ধার, কোনটা স্নেহের, কোনটা রক্তের বন্ধনের৷ সহোদর সহোদরা আবিষ্কৃত হয়েছে বৌদ্ধিক সচেতনতায়৷ যে কোন নারীর সাথে যে কোন পুরুষের অবাধ যৌন সম্পর্ককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সামাজিক শৃঙ্খলার খাতিরে৷ মানব জাতির ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়েছে বিয়ে নামক চুক্তি৷ নানা ধর্মে নানা বৈচিত্র্যময় চুক্তির ধরন৷ এই চুক্তির কারণে কেবল যে যৌন সম্পর্কে শৃঙ্খলা স্থাপিত হলো তা নয়৷ বরং এর সাথে যুক্ত হলো সামাজিক দায়বদ্ধতা৷ ভরণ পোষণ ও অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা৷ ক্রমে এতে আবশ্যিক স্রোত হয়ে মিশলো মানুষের মানবিক আবেগ৷ পারিবারিক মর্যাদা, বংশ মর্যাদা ইত্যাদি বেশ কয়েকটি বিষয়৷ উপজাত হিসাবে তৈরি হলো বিচ্ছেদ জনিত বেদনা ও ভোগান্তি,সামাজিক হেনস্থা৷ এই ধর্মীয় সামাজিক চুক্তির ফাঁক ফোকর গলে অনেকেই সুযোগ পেলো দায় এবং দায়িত্ব অস্বীকারের৷ ফলে একসময় এর সাথে যুক্ত হলো আইনি বাধ্যবাধকতা৷ সামাজিক শৃঙখলা ক্রমে আইনি বাধ্যবাধকতায় ওতোপ্রোতো ভাবেই জুড়ে গেলো অর্থনৈতিক প্রয়োজনের সাথে৷

এই উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে প্রধান দুটি ধর্ম হিন্দু এবং ইসলাম৷ দুটো ধর্মে বিবাহরীতি দু'রকম৷ ইসলাম ধর্মে বিয়ে সরাসরি চুক্তি৷ কাজি, যা কিনা বর্তমানে সরকার কর্তৃক নিয়োগ দেয়া কাজির মাধ্যমে সামর্থ্য অনুযায়ী দেনমোহর ধার্য করে মুসলিম বিয়ে সম্পন্ন হয়৷ যে বিয়েতে বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ আইন ও ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত৷ হিন্দু ধর্মেও বিয়ে একপ্রকার চুক্তি কিন্তু তা কিছুটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে৷ মন্ত্রোচ্চারণ, সাত পাক, স্ত্রী কে আজীবন ভরণ পোষণ এর মন্ত্র ইত্যাদির মাধ্যমে নারী পুরুষের বিবাহ বন্ধন৷ ঢাক ঢোল পিটিয়ে লোক সাক্ষী রাখা৷ হিন্দু আইনে এখনো বিচ্ছেদ স্বীকৃত নয়৷ ধর্মীয় আচরণের সাথে বিয়ে প্রথায় যুক্ত হয় নানা দেশীয় আচরণ৷ কাবিন আর দেনমোহরের বিয়েপ্রথায় যুক্ত হয়েছে এনগেজমেন্ট, গায়ে হলুদ,পান চিনি, রিসিপশন এর মতো আনুষ্ঠানিকতা৷ সাতপাকের বিয়ের বাঙালি রীতির আবশ্যিক পালনীয় রীতি অধিবাস সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে হয়ে গেছে গায়ে হলুদ৷ যেখানে কনে কিংবা বরকে সাজিয়ে গুজিয়ে সামনে পাশ্চাত্য রীতির কেইক আর ফলমূল সাজিয়ে এক হযবরল সংস্কৃতি৷ এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ভারতীয় দক্ষিণের নানা রীতিনীতি, আচার৷ বলা বাহুল্য এসবই হিন্দি সংস্কৃতিজাত৷ সেসব ভালো কি মন্দ সে প্রশ্ন উহ্য রেখে যে বিষয়টি আলোচনা জরুরি এই হযবরল সংস্কৃতির চাপে বিয়ে নামক রীতি এখন রীতিমতো দৈত্যের মতো হা করে গিলতে বসেছে মধ্যবিত্তদের৷

আসলে বিয়ে সংক্রান্ত সর্বজনবিদিত বিষয়গুলো আমার মূল আলোচ্য বিষয় নয়৷ আমার মূল দৃষ্টি আকর্ষণ সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্ট বিয়ে প্রথার এইকালে লোক দেখানো প্রতিযোগিতা৷

Ruma Modak
ছবি: privat

গল্পটি ছোটকালে আমাদের অনেকেরই পড়া৷ গণি মিয়া একজন গরীব কৃষক...৷ গণি মিয়ার সেই গল্পের মতো আমাদের হাল আমলের সব বিয়ে৷ ধর্মীয়, সামাজিক,লৌকিক এবং আইনগত প্রয়োজনের উর্ধ্বে বরং জাঁকজমকপূর্ণ লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা হয়ে উঠেছে এর মূল কাজ৷

বিয়ের বেনারসির ঐতিহ্য অনেক আগেই বাসি হয়েছে৷ সেখানে জায়গা করে নিয়েছে হিন্দি কালচারের লেহেঙ্গা৷ এসবের দাম শুনে আপনি চমকে যাবেন, কখনো লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায়৷ শুধু দাম শুনে চমকাবেন কেন, ওজন আগলে কোমর ব্যাথাও হতে পারে একেকজন৷ কনে একদিনের জন্য যে লাখ টাকার লেহেঙ্গা পরে তা আগলে নিয়ে যায় আরও জনা পাঁচেক স্বজন পরিজন৷ তারপর ' আমার বিয়ের লেহেঙ্গা, লাখ টাকা দাম...' উত্তর প্রজন্মের কাছে এই গল্প আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করা ছবির মাঝেই এর সীমাবদ্ধতা৷ এর আশ্রয় ঘরের ক্লজেট৷ একসময় ক্লজেটও হাঁপিয়ে যায় বোধ করি৷ এক বিশাল আপদ হয়ে দাঁড়ায় এই বিয়ের পোশাক৷

বিয়ের সাজসজ্জার মধ্যে চলে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা৷ সৈয়দ বাড়ির ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এ যে অংকের টাকার আলোকসজ্জা হয়েছে, চৌধুরী বাড়ির আলোকসজ্জা হতে হবে তার চেয়ে বেশি৷

বর কনের পার্লারে সাজার বিল বছর বিশেক বিয়ের খরচের চেয়েও বেশি৷ এখানেও প্রতিযোগিতা৷ খরচ আর বাহুল্যের প্রতিযোগিতা৷ হাল আমলের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রদর্শনী এই প্রতিযোগিতার অগ্নিতে দেখিয়ে দেয়ার ঘি ঢেলে যাচ্ছে পুরোদমে৷

কোথায় বর কনের চির পরিচিত লাজ নম্র আনত দৃষ্টি!  বলছি না এ খুব ভাল ছিলো, খারাপ ছিলো এও তো বলতে পারি না৷ এ ছিলো আমাদের ট্রাডিশন৷ হাল আমলের বিয়ের ভিডিওগ্রাফি দেখে আমি থ মেরে গেছি৷ এর নাম নাকি 'এন্ট্রি নেয়া'৷ নাচতে নাচতে ক্যামেরার লেন্স ফোকাসে ঢুকছে বর কনে৷ গায়ে হলুদের রাত তো নয়, পাড়া প্রতিবেশি, শিশু বৃদ্ধ টের পায় শব্দ দূষণের অত্যাচার কতো প্রকার ও কী কী! ডিজের বুক কাঁপানো সাউন্ডে সুস্থ জনেরও অসুস্থ হবার যোগাড়৷ কোথায় রসগোল্লার মিষ্টিমুখ, সেখানে ঢুকেছে বিশালাকৃতির কেক৷ আমন্ত্রিত অভ্যাগত অতিথি যারা এলেন, তারা নিজ দায়িত্বে এলেন, ব্যুফে নিয়ে খেলেন (ব্যুফে না দিলে মান থাকেনা কিনা), উপহার দিলেন চলে গেলেন৷ কারো সময় নেই তাদের খোঁজ নেয়ার,স্বাগত জানানোর৷

সব আয়োজন কেন্দ্রীভূত ফটোগ্রাফি আর ভিডিওগ্রাফিতে৷ নানা রং ঢং এ ছবি হলো কিনা, ভিডিও হলো কিনা,হিন্দি ছবির মতো 'নিম্বুরা,নিম্বুরা...' র মতো উদ্বাহু নৃত্য হলো কিনা৷ সাতদিন ধরে রাস্তার এ মাথা ও মাথার আলোক সজ্জায় পাড়া পড়শি জানলো কিনা এ বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে৷ বরপক্ষ কিংবা কনেপক্ষ খরচের বাহুল্যে মধ্যবিত্তের জীবন ওষ্ঠাগত৷ এক বিয়ের ঋণ কিংবা খরচ কুলাতে অভিভাবক কুল প্রায় নিঃস্ব এবং নির্বাক৷

বিয়ের নামে এই অত্যাচার কবে থেকে শুরু হলো,কে শুরু করলো আর হরেদরে বাঙালি তাতে গা ভাসিয়ে দিলো! আমি দেখি আর ভাবি, উত্তর পাই না৷ একি স্যাটেলাইট টিভির প্রভাব নাকি মানুষের হাতে আসা অবৈধ কাঁচা টাকার কড়াকড়ানির প্রভাব? আমি বলছি না কোন ট্রাডিশন এবসোলিউট, বদলানো যায় না কিংবা সময়ের প্রভাবে বদলে যায় না৷ সংস্কৃতি সবসময় দেশ,কাল স্থানের উপর নির্ভর করে নিয়ত পরিবর্তনশীল৷ কিন্তু যে সংস্কৃতি নিজস্ব ঐতিহ্য কে ধারণ করে থাকে,যাকে বদলে দিলে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণটাই বেশি,তাকে জোর করে কারা বদলে দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য