1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অসাম্প্রদায়িক চেতনার বর্ণাঢ্য আয়োজন

মোকারম হোসেন
১৬ এপ্রিল ২০১৮

নগর সভ্যতা আমাদের জীবনের দৌড়কে গতিময় করেছে, কিন্তু প্রাণবন্ত করে তুলতে পারেনি৷ তবুও আমরা জীবিকার প্রয়োজনে বার বার নিষ্প্রাণ এই নগরেই ফিরে আসি, চেষ্টা করি স্বপ্ন পূরণের৷ প্রান্তিক জনপদের আচার-অনুষ্ঠান নগরে উপনীত হয়৷

https://p.dw.com/p/2w33y
Bangladesch - Rural Fair
ছবি: DW/M. M. Rahman

গ্রামীণ সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলোকে শহরে এনে আমরা তাকে অনুভব করার চেষ্টা করি৷ অনেকক্ষেত্রে তা কৃত্রিম হলেও ক্ষণিকের আনন্দে মেতে ওঠে সবাই৷ নগরে বর্ষবরণ অনেকটা এভাবেই আমাদের শৈশবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়৷

গ্রাম বাংলায় পহেলা বৈশাখ মানে হালখাতা, মেলা আর নানান আনুষ্ঠানিকতা৷ হালখাতা মূলত ব্যবসায়ীদের একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান৷ মেলা এবং মেলাকেন্দ্রিক বিনোদন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত৷ বর্ষবরণকে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কয়েকজন সংস্কৃতিসাধক নিরন্তর কাজ করে চলেছেন৷ তারই ধারাবাহিকতার ফসল বর্ষবরণে বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ৷ ঢাকায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এবং চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়৷ এই দু'টি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ ঘটে৷ গ্রামের বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব ও সেবাসংঘের উদ্যোগেও বর্ণাঢ্যভাবে বর্ষবরণ করা হয়৷ মেলা, যাত্রা-পালা, সার্কাস, ঘোড়দৌড়, লাঠিলেখা, গম্ভীরা – এ সব নির্মল আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়েই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বর্ষবরণের আয়োজন৷

কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এই সাংস্কতিক আয়োজনগুলোকেও কখনো কখনো বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হয়েছে বাংলাদেশে৷ একটি বিশেষ গোষ্ঠী দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা চালিয়েছে৷ ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করা হয়৷ তাতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে৷ প্রায় অভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানেও বোমা হামলা করা হয়৷ উদ্দেশ্য ছিল দেশের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা৷ সাংস্কৃতিক চর্চার পরম্পরাকে বিঘ্নিত করা৷ কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি৷ বরং আজকাল বর্ষবরণে সর্বস্তরের মানুষের সম্পৃক্ততা আরো বেড়েছে৷ বিছিন্ন এ সব ঘটনা দেশের সংস্কৃতিমনা সাধারণ মানুষদের মনে গভীর কোনো রেখাপাতই করেনি৷ তাছাড়া পহেলা বৈশাখকে ঘিরে এই যে বিপুল ও বর্ণাঢ্য কর্মযজ্ঞ, তাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করছে৷ এটি একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব৷ প্রথম থেকেই এই উৎসবকে ঘিরে কোনো ধর্মীয় বিভাজন নেই৷ মূলত বর্ষবরণ বাঙালিদেরই নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান, যাতে শতভাগ বাঙালিয়ানার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷

কয়েক বছর ধরেই বর্ষবরণের অনুষ্ঠানগুলোতে কয়েক স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হচ্ছে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ষিয়ে যথেষ্ট তৎপর৷ ফলে বর্তমানে নিরাপত্তাজনিত কোনো সংকটই আর অনুভূত হচ্ছে না৷ যদিও বছর দুয়েক আগে বিছিন্নভাবে দু-একটি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছিল৷ তবুও সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ সেই ক্ষতচিহ্নকে মুছে দিয়েছে৷ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুসংহত হওয়ায় সংস্কৃতিমনা সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারছেন৷ নগরজুড়ে বর্ষবরণকে ঘিরে এই যে উৎসবমুখর পরিবেশ, তার শিকড় কিন্তু গ্রামে৷ গ্রামে বর্ষবরণের প্রধান আকর্ষণ বৈশাখি মেলা৷ কীভাবে এই মেলার প্রচলন হয়েছে এবং তা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে, সে বিষয়ে জানতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে৷

বাংলাদেশে প্রচলিত প্রতিটি মেলা শুরুর পেছনে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে৷ সেটি হয় ধর্মীয়, না হয় পালা-পার্বণ অথবা যে কোনো একটি নির্বাচিত বিষয়কে কেন্দ্র করে হয়৷ সাধারণত তিথি ও লগ্ন অনুযায়ী ঘটে সর্বস্তরের মানুষের এই সমাবেশ৷ আর যে কোনো ধরনের সমাবেশ মানেই মেলার একটি আবহ তৈরি হওয়া৷ মেলার বিশেষ আকর্ষণ সারা বছর ব্যবহার্য পণ্য ও গৃহসামগ্রীর বিরাট সমাবেশ৷ মেলার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথমেই এ অঞ্চলের হাজার বছরের পুরনো মেলার কথা বলতে হয়৷

মেলার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন ‘চিলাইর মেলা'৷ এখনো বাংলাদেশের সর্বত্র, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বৈশাখ মাসের এক তারিখ থেকে সাত তারিখ পর্যন্ত বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে উদ্যাপিত হয় এই মেলা৷ মেলাটি ঐতিহাসিক বলেই অনেক ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধনের শিকার৷ তবে চিলাই মেলা বা চিলাই ব্রতের অনেক আচার-অনুষ্ঠান হারিয়ে গেছে৷ চিলাই নামের এ মেলাটি কোথাও আবার ‘চিনার মেলা' হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে৷ হয়ত এ ব্রত উপলক্ষ্য একসময় গ্রামে গ্রামে উৎসবের আমেজে নারী-পুরুষের ঢল নামত আর সে গ্রামের প্রধান বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে যেত নানা সামগ্রীর মেলা৷

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ও আলোচিত এ ধরনের উৎসব ও মেলাগুলো যে সময়ের দিক থেকে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন স্মৃতি ও ঐতিহ্য বহন করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু আজ অধিকাংশ ঐতিহ্যবাহী পার্বণ ও মেলাই সামাজিক, অর্থনৈতিক, বিশেষ করে পারিপার্শ্বিকতার চাপে ক্রমাবনতি ও বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে৷ এমনকি ইতোমধ্যেই কিছু কিছু ঐতিহ্যবাহী পালা-পার্বণ, আচার ও মেলার বিলুপ্তি ঘটেছে বলেও মনে করা হয়৷ তারপরও আমাদের এই আঞ্চলিক আচার-অনুষ্ঠান ও মেলাগুলোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে বাঙালির বৎসরব্যাপী সংস্কৃতি ও লোক-ঐতিহ্যের ধারা৷

বৈশাখ আপাতদৃষ্টিতে বছরের প্রথম মাস হলেও এর সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি বিশাল৷ আমাদের ঐতিহ্য-চেতনার সঙ্গেও বৈশাখের নিবিড় সখ্যতা আছে৷ হালখাতা এবং মেলা এই মাসের দু'টো প্রধান দিক৷ সবকিছু মিলিয়ে এই জনপদে বৈশাখের প্রভাব তুমুল৷ আমাদের সাহিত্যে, ইতিহাসে, সামাজিকতায়, লোকাচারে বৈশাখ অনিবার্যভাবে এসেছে৷

শুভ নববর্ষে ঐতিহ্যগতভাবে বৈশাখি মেলা, খেলাধুলা, গঙ্গায় স্নান, পুণ্যাহ, হালখাতা, ঘোড়দৌড়, ভূমিকর্ষণ, রকমারি স্বাদের খাবার, নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ, নৃত্য, যাত্রা ইত্যাদির আয়োজন হয়৷ এটি এখন নববর্ষের ঐতিহ্যিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে৷ প্রসঙ্গত অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান উল্লেখ করেন, ‘বাংলা সন' প্রবর্তিত হওয়ার পর বাঙালির প্রাচীন উৎসব-অনুষ্ঠান, মেলা, লৌকিক খেলাধুলা, হালখাতা, পুণ্যাহ প্রভৃতি এ সনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কোনো বাধা সৃষ্টি হয়নি৷ অর্থাৎ বাঙালির লোকজীবনের সাংস্কৃতিক ধারাকে বাংলা সন বিছিন্ন না করে বরং জোরদার করেছে৷ বৈশাখের উৎপত্তি যেভাবেই হোক না কেন তা আজ লোক-ঐতিহ্যর ধারায় বাঙালির উৎসব-অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে৷ আমাদের খ্যাতিমান কবিদের সত্তায়ও বৈশাখ ঝড় তুলেছে৷ বাংলা কাব্যে রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম ঋতু-চেতনা নিয়ে এসেছিলেন৷ বৈশাখের আবির্ভাবে অতীতের গতিহীন জীবনের দীনতা, জড়তা, ক্লেদ, গ্লানি ও পাপ মুছে যায়৷ ‘দূরান্তের পলাতক বলাকার ঝাঁকে' পুরাতন বছরের সব আবর্জনা, জঞ্জাল উড়ে যায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়৷ অবশ্য এ চিত্র আমরা খুব বেশি কবির কাব্যে দেখি না৷ কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই ছিলেন ‘অকাল বৈশাখী ঝড়'৷ ‘প্রলয়োল্লাস' কবিতাটি তিনি বৈশাখকে আবাহনের উদ্দেশ্যেই রচনা করেছিলেন:

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!

ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়৷

কবি জসীমউদ্দীন বৈশাখ নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ চিত্রকল্প তৈরি করেননি৷ তবে বৈশাখের রুক্ষ ও শুষ্ক রূপকে তিনি তাঁর কাব্যোপন্যাসে যেভাবে ধারণ করেছেন, তাতে তাঁর কবিতায় স্বাতন্ত্র্যেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে৷ যেমন:

চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে,

এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামল না গাঁর বাটে৷

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখকে, বৈশাখের রুদ্র ও ভয়াল রূপকে সাহিত্যের বিভিন্ন মাত্রিকতায় প্রত্যক্ষ করেছেন৷ মানুষের দুঃখ-শোক, হতাশা, নিরাশা, জরা-মৃত্যু, ক্ষুধা ও তৃষ্ণা তাড়ানিয়া শক্তিরূপেই তিনি আবার একে কল্পনা করেছেন৷ জীবনের সবটুকু গ্লানি মুছে দিতে তিনি বৈশাখকে আহ্বান করেছেন এভাবে:

এসো হে বৈশাখ, এসো এসো

তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষূরে দাও উড়ায়ে,

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক৷৷

আমাদের কথা-কবিতায় বৈশাখ অনেকভাবেই এসেছে৷ কবিদের স্বপ্নিল পংক্তিমালা কিংবা ইতিহাসবেত্তাদের প্রাঞ্জল উপস্থাপন বৈশাখের উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরিতে অসামান্য অবদান রেখেছে৷ বসন্তের প্রস্ফুটিত পুষ্প উচ্ছাসের নান্দনিক দিনগুলো শেষ হতে না হতেই গ্রীষ্মের তপ্তদিন চলে আসে৷ কিন্তু হঠাৎ করেই ঈশান কোণে ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা যায়৷ অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ৷ শোঁ শোঁ শব্দে ধেয়ে আসে ঝড়৷ হঠাৎ যেমন আগমন, হঠাৎ করেই উধাও৷ আবার ঝলমলে আকাশ৷ এমন দিনেই মেলা হয় বটতলায়, কালীতলায়, মঠ প্রাঙ্গণে৷ অনেকখানে মেলা মানেই তো উৎসবমুখর আনন্দময় পরিবেশ৷

বৈশাখজুড়েই ছোট-বড় নানা ধরনের মেলা দেশের নানা স্থানে অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়৷ সাধারণত গ্রামাঞ্চলের বট বা অশ্বত্থের নীচেই এ সব মেলা অনুষ্ঠিত হয়৷ এতে লোকশিল্পের চমৎকার সমাবেশ ঘটে৷ সাধারণত স্থানীয় লোকদের উদ্যোগেই এ সব মেলার আয়োজন হয়৷ ইদানীং সরকারি উদ্যোগেও বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ তবে আশার কথা যে এ সব বৈশাখি মেলার সঙ্গে এখন বইমেলাও সংযোজিত হয়েছে৷ রাজধানী কিংবা শহরকেন্দ্রিক মেলাগুলোতেই বেশি বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়৷ পাশাপাশি এ সব জায়গায় বিনোদনের ব্যবস্থাও বিবেচ্য বিষয়৷

বৈশাখি মেলা সাধারণত এক দিন থেকে তিন দিন অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক সপ্তাহও স্থায়ী হয়৷ এক দিনের জন্য যে মেলা বসে, আঞ্চলিক ভাষায় তাকে ‘বান্নি' বলা হয়৷ ‘বান' শব্দ থেকেই কি বান্নি শব্দের উৎপত্তি? যেহেতু এতে চতুর্দিক থেকে বানের মতোই মানুষ আসে৷ বৈশাখি মেলা বাঙালির সর্বজনীন উৎসবের এক ভগ্নাংশ মাত্র৷ বর্তমানে এটি একটি সাংস্কৃতিক লোক-উৎসবে পরিণত হয়েছে সারা দেশে৷ এটি কোনো ধর্মীয় ঐতিহ্য, কিংবদন্তি কিংবা বিভিন্ন পালা-পার্বণনির্ভর অনুষ্ঠান নয়৷ সে কারণেই সমস্ত বাংলা ও বাঙালির লোকায়ত সংস্কৃতির অভিন্ন পলিমাটির সমন্বয়েই এটি গড়ে উঠেছে৷

এ দেশে জমিদারি খাজনা আদায়ের লক্ষ্যেই সম্ভবত বৈশাখি মেলার পত্তন ঘটে৷ অনেকের ধারণা, খাজনা আদায়কে একটি আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য মূলত চৈত্রসংক্রান্তির মেলার উৎপত্তি হয়েছিল৷ প্রসঙ্গত পণ্ডিতদের গবেষণা স্তবক শোনা যাক৷

চিত্রা নক্ষত্র হইতে চৈত্র হইল নাম

বসন্ত বিদায় নিল, বর্ষ শেষ যাম –

চড়কের উৎসব, গাজনের গান

সেই সঙ্গে বর্ষ হইল অবসান৷৷

এই বর্ষশেষ দিনেই চৈত্র সংক্রান্তির মেলা৷ পরদিনই নববর্ষ, নববর্ষের মেলা৷ অর্থাৎ একে অনুসরণ করেই চালু হয় বৈশাখি মেলা৷ একটা নতুন বছরকে বরণ করার জন্য জমিদার-প্রজারা মিলেই উৎসবের সৃষ্টি করে৷ তাই সংগত কারণেই বলা চলে বৈশাখি মেলা আমাদের প্রাচীন লোক-উৎসবেরই একটি ধারা৷

আমাদের আরেকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, বাদশাহ আকবরের নবরত্ন সভার আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজিই বাদশাহি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ফসল অব্দের প্রবর্তন করেছিলেন হিজরি চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষের হিসাবমতো মিলিয়ে নিয়ে৷ আমির সিরাজিই হিজরিকে বাংলা সনে সমন্বয় সাধন করেছিলেন এবং পয়লা বৈশাখ থেকেই বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেছিলেন৷ আর বিশাখা নক্ষত্রের নাম থেকেই ‘বৈশাখ' নামের উৎপত্তি হয়েছিল৷ এই তথ্যটিও চমৎকারভাবে কবিতায় উঠে এসেছে:

বিশাখা হইতে নাম হইল বৈশাখ

আরম্ভিলা গ্রীষ্মকাল, প্রখর নিদাঘ

এই মাস হতে বঙ্গে বর্ষ শুরু হয়

সিদ্ধিদাতা জগানন গণেশ কৃপায়৷৷

বৈশাখি মেলা বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির আয়নাবিশেষ৷ধারণা করা হয় যে এই মেলার বয়স ১৫০ থেকে ৬০০ বছর পুরনো৷ বৈশাখ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মেলার সংখ্যা ৩০০-৩৫০টি৷ এগুলো অবশ্যই প্রাচীন এবং যে কোনো নির্দিষ্ট স্থান ঘিরে আয়োজিত হয়৷ তবে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, বর্তমানে নানা কারণে অনেক পুরনো মেলা হারিয়ে গেছে৷ আবার যুক্ত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নতুন নতুন বৈশাখি মেলা৷ মেলার ক্ষেত্রে এমন ধারাবাহিকতা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই৷ সুতরাং কোনো মেলাই চিরস্থায়ী নয়৷ কোনো কোনো মেলা যেমন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তেমনি এর সময় ও স্থানেরও পরিবর্তন ঘটতে পারে৷ ইদানীং বাণিজ্যিক প্রসারের কথা বিবেচনা করে যেসব মেলার আয়োজন করা হচ্ছে – যেমন কম্পিউটার মেলা, কুটিরশিল্প মেলা, বস্ত্রমেলা, বাণিজ্য মেলা, পুষ্পমেলা, চামড়াজাত শিল্পমেলা – সেগুলো একেবারেই ভিন্ন ধাঁচের মেলা৷

বর্তমানে অধিকাংশ শহরে বেশ পরিকল্পিতভাবে বৈশাখি মেলার আয়োজন করা হলেও মূলত এ ধরনের মেলা অতিমাত্রায় গ্রামকেন্দ্রিক৷ গ্রামেই এ সব মেলার আবেদন বেশি৷ গ্রামেগঞ্জে কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমোর, ময়রা, স্যাকরা এবং অন্য শিল্প ও কারিগরেরা যেসব সামগ্রী তৈরি করে, বৈশাখি মেলায় তা প্রদর্শন ও বিক্রির সুযোগ পায়৷ গ্রামীণ কৃষিজাত পণ্য, কুটিরশিল্পজাত পণ্য, মিষ্টান্ন দ্রব্য, মাটির তৈরি শিল্পসামগ্রী প্রভৃতি নিয়ে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা মেলায় দোকান সাজিয়ে বসে৷ বাঁশ ও তালপাতার রঙিন বাঁশি, ভেঁপু, ডুগডুগি, একতারা, দোতারা, বেলুন, লাটিম, মার্বেল, ঘুড়ি-লাটাই, চরকি, পুতুল, কাঠের ঘোড়া, মাটির হাঁড়ি-বাসন, কলস, পুঁতির মালা, চুড়ি ইত্যাদি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা৷ এছাড়া আছে কাঠের আসবাব খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, চৌকি, আলনা, আলমারি, পিঁড়ি, ঢেঁকি, গাড়ির চাকা প্রভৃতি৷

কামারশালায় তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিসও মেলায় পাওয়া যায়৷ ময়রারা তৈরি করে নানা রকম মিষ্টান্ন দ্রব্য খাজা, ছাঁচের মিঠাই, বাতাসা, কদমা, জিলাপি, নকুলদানা ইত্যাদি৷ এ সব আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনি মেলার প্রচলিত রীতিকে ধরে রেখেছে৷ মুড়ি, মুড়কি, খই, চিড়ে, মোয়া, তিলের লাড্ডু, বুট, চানাচুর, মটরভাজা এখনো মেলায় প্রিয় খাবার৷

তাঁতিরা মেলায় নিয়ে আসে নকশা পাড়ের শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, গামছা প্রভৃতি৷ আরো থাকে শীতলপাটি, নকশিকাঁথা, পিতলের তৈরি সামগ্রী ও  প্রসাধনী৷ স্যাকরার দোকানে মেয়েরা ভিড় জমায় রুপা, তামা ও পিতলের গয়না কিনতে৷ কোনো কোনো বৈশাখি মেলায় গ্রামের শ্রমজীবী মানুষের উন্নত জীবন গঠনের উপযোগী শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে৷ মেয়েদের তৈরি নানা প্রকার মাদুর, পাখা, শিকে, কাঁথা এবং বেতের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী সাজানো থাকে৷

মানুষ মেলায় এসেই বিভিন্ন ধরনের আনন্দ ও বিনোদনমূলক উপকরণ খুঁজতে আগ্রহী হয়৷ তাই মেলার আয়োজকরাও বিষয়টি বিবেচনায় রাখেন৷ যাত্রা, কবিগান, পালাগান, জারিগান, গম্ভীরা, কীর্তন, বাউলগান, পুতুলনাচ, জারিয়াল নাচ, লাঠিয়াল নাচ, সার্কাস প্রভৃতি বৈশাখি মেলার অন্যতম বিনোদনমাধ্যম৷ আমাদের দেশজ খেলাগুলো এখনো যে মানুষকে আনন্দ দিতে পারে তার প্রমাণ মেলে বৈশাখি মেলায়৷ অবশ্য অঞ্চলভেদে এ সব খেলার ধরন এবং উপস্থাপনাজনিত তারতম্য লক্ষণীয়৷

মোকারম হোসেন
মোকারম হোসেনছবি: privat

একসময় বৈশাখি মেলার প্রধান ক্ষেত্র ছিল গ্রাম৷ তিন নদীর মিলনস্থল, পথের তেমাথায়, ফাঁকা মাঠ, কিংবা বিশাল বট, অশ্বত্থগাছের নীচে মেলা বসত৷ যেখানে অনেক লোক এসে জড়ো হতে পারত৷ কালক্রমে মেলার স্থান গ্রাম থেকে শহরে বিস্তৃত হয়েছে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে৷ তাই পয়লা বৈশাখ বর্ষবরণের দিন হিসেবে সারা দেশ সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়৷ ধীরে ধীরে রাজধানী ঢাকা হয়ে ওঠে এই উৎসবের কেন্দ্র৷ ছায়ানট, বাংলা একাডেমি, নজরুল একাডেমী, শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকায় নববর্ষের উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে৷ আগে বৈশাখি মেলার মূল কেন্দ্র ছিল বাংলা একাডেমি৷ বাংলা ১৩৮৫ সন থেকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক) ধানমন্ডি মাঠে নিয়মিত বৈশাখি মেলার আয়োজন করে আসছে৷ এই মেলার ব্যাপ্তিকাল সাত দিন৷ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত বিসিক-এর বৈশাখি মেলা দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে৷

বস্তুত শহর বা নাগরিক জীবনে মেলা তেমন প্রভাব বিস্তার না করলেও গ্রামীণ জীবনে এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে৷ এদিক থেকে বৈশাখি মেলা তাৎপর্যমণ্ডিত৷ কারণ গ্রামীণ ঐতিহ্যময় কুটিরশিল্প এবং অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সর্বাধিক সমাবেশ ঘটে মেলায়৷ মেলার কারণে অনেক অবলুপ্ত বা বিস্মৃতপ্রায় শিল্প ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়৷ সেই সঙ্গে গ্রামীণ পণ্য বাজারজাতকরণের বিশেষ সুযোগও রয়েছে৷ কিছু কিছু বৈশাখি মেলা বেশ প্রাচীন এবং আদৃত৷ সেই সুবাদে ঐতিহ্যবাহীও বটে৷ চট্টগ্রামে বৈশাখি মেলার অন্যতম আকর্ষণ ‘জব্বারের বলি খেলা'৷ একদিনের এই বলি খেলা উপভোগ করতে সমবেত হয় অসংখ্য মানুষ৷ চৈত্রের শেষে চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায় আয়োজন করে ‘মহামুনির মেলার'৷ এই মেলা বর্ষবরণেরই অংশ৷ চট্টগ্রামের আদিবাসী মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসব পরিচিত সাংগ্রাই, বিজু বা বিহু নামে৷

কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়ার চান্দলা গ্রামের বৈশাখি মেলা একটি বিখ্যাত মেলা৷ এই মেলা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ৷ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাট, ভাদুঘর, খড়মপুর, নবীনগর প্রভৃতি স্থানে বৈশাখি মেলা জমে ওঠে৷ তিতাস নদীর তীরে ভাদুঘরের মেলা বসে বৈশাখের ১৪ তারিখ৷ হাজার হাজার মানুষ আসে এই মেলায়৷

উত্তরবঙ্গের উল্লেখযোগ্য বৈশাখি মেলার মধ্যে দিনাজপুরের আমবাড়ির মেলা, বগুড়ার গাঙনগর মেলা, যশোরের নিশিনাথতলার মেলা, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বিত্তিপাড়ায় ঘোড়াপীরের আস্তানায় ওরস উপলক্ষ্যে বৈশাখ মাসে বিশেষ মেলা বসে৷ এই মেলা চলে মাসব্যাপী৷ বরিশালে বাকালের মেলাও বিখ্যাত৷ এমন অসংখ্য মেলায় মুখরিত থাকে বৈশাখের দিনগুলো৷ আমাদের সংস্কৃতির অনিবার্য উৎসব হিসেবে বৈশাখ বেঁচে থাকবে অনন্তকাল৷

লেখাটি কেমন লেগেছে? লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান