1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘ভারতকে একটি হিন্দু রাজ্যে পরিণত করো’

ফ্যানি ফাকসার/এসি/এসিবি২৩ আগস্ট ২০১৭

ডয়চে ভেলের ফ্যানি ফাকসার গিয়েছিলেন নব্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে৷ গিয়ে তাঁর উপলব্ধি হয়েছে ভারতে ধর্মের শিকড় সম্ভবত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেয়ে বেশি গভীর৷

https://p.dw.com/p/2ih7Y
Fanny Facsar
ছবি: DW/F. Facsar

নতুন দিল্লিতে নেমেই গাড়ির হর্ন আর নানারকম আওয়াজে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেল৷ সেই চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে আবার হাজার হাজার গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে, হিন্দুদের কাছে যে জীবটি পবিত্র৷ ভারতের ৮০ শতাংশ নাগরিক হিন্দু৷

ভারতের অনেক রাজ্যেই গরুকে পবিত্র বলে বিবেচনা করা হয়, কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে সেই পবিত্র জীবটিকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করা হচ্ছে৷ ভারতের ফেডারাল শাসনতন্ত্রে প্রতিটি রাজ্য স্থির করতে পারে, তারা গরু মারা নিষিদ্ধ করতে চায় কিনা৷ কেন্দ্রীয় সরকার চান সারা দেশে গোহত্যা নিষিদ্ধ করতে৷ এবং এই নিষেধের বিরোধীদের সকলকে অ্যান্টি-ন্যাশনাল বা জাতীয়তাবাদের বিরোধী বলে গণ্য করা হচ্ছে৷

ভারতে সংখ্যালঘুরা আজ অনিশ্চিত বোধ করছে৷ এবং ভারতের আকার ও আয়তনের কারণে এখানে সংখ্যালঘু বলতে একটি সুবিশাল জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে পারে৷ ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘু প্রায় ১৮ কোটি – এবং তারাই প্রধানত এই পরিকল্পিত গোহত্যা নিষেধের মূল্য দিচ্ছে৷ স্বনিযুক্ত পাহারা পরিষদের হাতে একাধিক মুসলিমকে গরুর মাংস খাওয়া অথবা গরু মারার কারণে ইতিমধ্যেই প্রাণ দিতে হয়েছে৷

ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তরুণ সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলি৷ আমি বুঝতে পারি যে, ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা আর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা গো-হত্যার বিষয়টিকে ছাড়িয়ে অনেকদূর পৌঁছে গেছে৷ বহু জাতীয়তাবাদী হিন্দু আর ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে মানতে রাজি নন; তাঁরা চান একটি হিন্দু রাজ্য, এবং একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন তা করা সম্ভব, মনে করেন তাঁরা৷ 

বিশেষ করে তরুণ জনতা মোদীর জন্য ভোট দিয়ে থাকে৷ দিল্লি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ললিত তানওয়ারের সঙ্গে দেখা হলো৷ ললিত আরএসএস-এর সঙ্গে যুক্ত একটি জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠনের সদস্য৷ আরএসএস-কে শাসক বিজেপি দলের মতাদর্শের উৎস বলে মনে করা হয়৷

ললিত যে আমাদের আলোচনার সময় নিজেকে উদারপন্থি ও আধুনিক হিসেবে পেশ করার চেষ্টা করেছে, তাতেই আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছি৷ কিন্তু মুসলিমদের প্রসঙ্গ উঠলেই তার অন্ত ঘটে৷ ‘‘মুসলিমরা আসার আগেও হিন্দু ঐতিহ্য ছিল; এটা চিরকালই একটা হিন্দু দেশ ছিল৷ কাজেই আমরা বহিরাগত সংস্কৃতির অনুসরণ করব না'', ললিত বলে৷ ভারতের মুসলিমরা ‘বহিরাগত', তারা নাকি ‘ভারতের বাস্তবিক সত্তা'-কে বিপন্ন করে এবং সেই সত্তা ‘পুরোপুরি হিন্দু', বলে ললিতের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মত৷

সমালোচনা করা মানেই অ্যান্টি-ন্যাশনাল

ললিতের সাথে আবার দেখা তাঁর পাড়ায়৷ সে তখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের আয়োজনে ব্যস্ত৷ সারা শহরে জাতীয় পতাকা ঝুলছে, ললিতের বাড়ি হিন্দু দেবদেবী ও সন্তদের ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে৷ ললিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণের একটি অক্ষরও ‘মিস' করতে চায় না৷ প্রধানমন্ত্রী আবার চাকরি সৃষ্টির ও ভারতকে বহির্বিশ্বের ও অভ্যন্তরীণ শত্রুদের হাত থেকে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন৷

কিন্তু সকলেরই স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মতো মনের অবস্থা নয়৷ আমি একাধিক টুইট পেলাম, যেখানে বাকস্বাধীনতার হানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে৷ মোদীর সমালোচকরা বলেন যে, ভিন্নমত পোষণকে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ শত্রু বলে গণ্য করা হচ্ছে, যা সমূলে উৎপাটন করা প্রয়োজন বলে মোদী সমর্থকদের ধারণা৷

এ যাবৎ ভারতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি৷ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার সময় মোদী যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি তা পূরণ করতে পারছেন না৷ দিল্লির রাস্তায় আমি বহু মজদুর শ্রেণির মানুষ দেখলাম, যাঁরা তার ভুক্তভোগী৷

চাকরির অভাব৷ যদিও মোদী শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ এক্ষেত্রে মোদীর ওপর চাপ যত বাড়ছে, ততই তাঁর সরকার জাতীয়তাবাদ ও অগ্নিগর্ভ ভাষণের দিকে ঝুঁকছে৷ হিন্দুধর্মের অঙ্গ হবার অনুভূতি দিয়ে ভোটারদের খুশি রাখার পন্থা সংখ্যালঘুদের আরো দূরে ঠেলে দিচ্ছে৷

ধর্মীয় অনুভূতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেয়ে গভীর

আমার ভারত সফরের সময় আমি বুঝতে পারি যে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিক কাঠামোর নীচেই এমন সব আবেগ-অনুভূতি রয়েছে, যেগুলি ধর্মের সঙ্গে যুক্ত৷ ‘‘মানুষজনকে শুধুমাত্র জাতির গর্ব, ধর্মের গর্ব, দেশপ্রেমের গর্ব দিয়ে বারংবার ভোটে জেতা সম্ভব, যদিও তাদের বাস্তব পরিস্থিতিতে কোনো পরিবর্তনই হচ্ছে না'', বললেন রানা দাশগুপ্ত৷ তিনি একজন দিল্লিবাসী লেখক ও ভারতে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত৷

দেখলে মনে হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও অপরাপর বিশ্বনেতার মতোই মোদী এমন একটি রাজনৈতিক ফর্মুলা খুঁজে পেয়েছেন, যার মূলমন্ত্র হলো ক্ষমতা বাড়ানো বা ক্ষমতায় থাকার জন্য জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করা ও যুগপৎ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করা৷ মোদীর জাতীয়তাবাদ অন্যান্যদের চেয়ে সূক্ষ্ম হতে পারে: তিনি প্রায়ই ঐক্য ও উন্নয়নের কথা বলে থাকেন, কিন্তু তার নীচে হিন্দু জাতীয়তাবাদের যে প্রচ্ছন্ন ধারা প্রবহমান, তা ধর্মনিরপেক্ষতাকে দেশপ্রতিষ্ঠার বুনিয়াদি নীতি হিসেবে বিচ্যুত করতে পারে৷ ভারতে জাতীয়তাবাদের বৃদ্ধি গণতন্ত্রের পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াতে পারে৷