1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মতপ্রকাশের পথ আরও রুদ্ধ করতেই কি নতুন আইন?

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৩ মে ২০২২

আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে৷ সরকার সেটিকে বাতিল করে পরে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামে আলাদা একটি আইন করে৷

https://p.dw.com/p/4BEYQ
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain

এখনও এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে৷ কারণ এই আইনটি ৫৭ ধারার চেয়েও বেশি বিতর্কিত এবং নিপীড়নমূলক৷ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অনেকটাই রুদ্ধ করে দিয়েছে৷ এবার নতুন করে আরও তিনটি আইন ও নীতিমালা হচ্ছে৷ আইনগুলো বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও মত প্রকাশের যতটুকু স্বাধীনতা আছে, নতুন আইনের ফলে এটুকুও রুদ্ধ হয়ে যাবে৷ মানুষ এখন সামাজিক মাধ্যমে যতটুকু মত প্রকাশ করতে পারেন, নতুন আইন সেই পথকেও আইনের বেড়াজালে আটকে ফেলছে৷ পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সেলফ সেন্সরশিপ আরও বেশি তৈরি হবে৷

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নতুন এই আইনগুলো পর্যবেক্ষণ করছে৷ প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নতুন যে আইনগুলো হচ্ছে, এগুলো দরকার ছিল৷ কিন্তু যেভাবে করা হচ্ছে, তাতে আইনের অপব্যবহারের সুযোগই বেশি থাকছে৷ আইনগুলোতে স্পষ্ট কোনো ব্যাখা রাখা হয়নি৷ ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা এটার অপব্যবহারের যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে সেটা অমূলক নয়৷’’

নতুন যে আইনগুলো হচ্ছে, এগুলো দরকার ছিল, কিন্তু অপব্যবহারের সুযোগই বেশি থাকছে: ড. ইফতেখারুজ্জামান

২০০৬ সালে আইসিটি আইনটি হলেও ২০০৮ সালের আগে এই আইনের ৫৭ ধারায় কোনো মামলা হয়নি৷ ২০০৮ সালে র‌্যাবের ওয়েবসাইট হ্যাক করায় তিন যুবকের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয় ৫৭ ধারায়৷ এরপর পার্থ নামের এক যুবক প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দেয়ায় দ্বিতীয় আলোচিত মামলা হয়৷ এরপর এই আইনটি গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হলে সমালোচনা বাড়তে থাকে৷ আইনটি বাতিলের দাবিও জোরালো হয়৷ এক পর্যায়ে সরকার ওই আইন বাতিলের কথা জানায়৷ পাশাপাশি এ বিষয়ে নতুন আইনের তোড়জোড় শুরু হয়৷ ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়৷ তার আগে থেকেই আইনটি অপব্যবহারের শঙ্কা প্রকাশ করেন গণমাধ্যমসহ সুশীল সমাজ৷ তখন আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, কোনো একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনটির অপব্যবহার হলে তিনিই তার পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নামবেন৷ পরে দেখা গেল গণহারে সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনটি ব্যবহার করে মামলা করা হচ্ছে৷  

আমার বিশ্বাস নীতিনির্ধারকেরা সমালোচনাগুলো আমলে নিয়ে আইনটির সংশোধন করবেন: মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল

সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইন তো সব সময় ইতিবাচক মানসিকতা থেকেই করা হয়৷ আইনের প্রয়োজনীয়তাও আছে৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে আমরা আগে থেকেই শঙ্কার কথা বলেছি৷ এখনও বলছি৷ নতুন যে আইনগুলো হচ্ছে, এগুলো নিয়েও আমাদের কথা বলতে হবে৷ সরকার শুনতেও পারে, নাও শুনতে পারে৷ যদি না শোনে তাহলেও আমরা বলতে পারব, আমরা তো আগেই শঙ্কার কথা বলেছিলাম৷ আমার বিশ্বাস নীতিনির্ধারকেরা এই সমালোচনাগুলো আমলে নিয়ে আইনটির সংশোধন করবেন৷’’

ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে করা হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন৷ এই আইন পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে৷ পুলিশ এ আইনে দেওয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারছে৷ এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না৷

নির্বাচনের আগে সরকার মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে: শাহদীন মালিক

আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই আইনটির দু'টি দিক আছে৷ একটি সাইবার ক্রাইম এবং আরেকটি বাকস্বাধীনতার বিষয়৷ আইনটি করার পর আমরা যেটা দেখলাম, সাইবার ক্রাইমের ধারাটি ব্যবহার হচ্ছে না৷ বাকস্বাধীনতার বিষয়ে একটার পর একটা মামলা হচ্ছে৷ এটা আসলে বাক স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের জন্যই করা হয়েছে৷ ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে এই আইনটি করা হয়েছিল৷ সামনের বছর আবারও নির্বাচন৷ ফলে এখন নতুন করে কিছু আইন করা হচ্ছে৷ নির্বাচনের আগে সরকার মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে৷ আগের আইনটির যেভাবে অপব্যবহার হয়েছে, এটাও হবে সেটা বলাই যায়৷’’

অবশ্য বাংলাদেশ ইউনিভার্সির্টি অব বিজসেন অ্যান্ড টেকনোলজির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানভীর হাসান জোহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন ডেটা প্রোটেকশন আইন যেটা হচ্ছে, সেটার আসলে প্রয়োজনীয়তা আছে৷ এখন আমাদের তথ্য নানাভাবে নানাজনের কাছে চলে যাচ্ছে৷ যেমন কোনো সুপারশপে আপনি কিছু কিনলেন, সেখানে আপনার দেওয়া ফোন নম্বরটি তারা কিন্তু অন্য কারও কাছে তারা দিয়ে দিচ্ছে৷ নতুন এই আইনের ফলে তারা সেটা করতে পারবে না৷ তবে আইনটির আরও বেশি ব্যাখার প্রয়োজন রয়েছে৷ তা না হলে অপব্যবহারের আশঙ্কা তো থাকবেই৷’’

এখন যে তিনটি প্রস্তাবিত আইন, রেগুলেশন ও নীতিমালা হচ্ছে সেগুলো হলো তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের তৈরি ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট-২০২২, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তৈরি রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক সেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা, ২০২১৷ এই তিনটি আইন ও নীতিমালার খসড়া নিয়ে ইতিমধ্যে নানা ধরনের সমালোনা হচ্ছে৷ বিটিআরসির তৈরি করা রেগুলেশনটি ইতিমধ্যে হাইকোর্টে জমা দেওয়া হয়েছে৷ আদালতের নির্দেশেই এটা তৈরি করা হয়েছে৷

এই রেগুলেশন নিয়ে ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিটিআরসি যে রেগুলেশনটি করছে, যেটা বলা হচ্ছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে করেছে৷ আমি ওই শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত ছিলাম৷ সেখানে মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব৷ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের এখানে ব্যবসা করে যাচ্ছে, অথচ রেভিনিউ দিচ্ছে না৷ এখন যে ড্রাফটটা তৈরি করেছে সেখানে রাজস্ব নিয়ে একটা শব্দও নেই৷ আল্টিমেটলি ওই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা চলে এসেছে৷’’

ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট-২০২২ ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য প্রকৃতপক্ষে কতটা সুরক্ষা দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ বিশেষ করে নতুন আইনে ব্যক্তিগত ডাটা স্থানান্তরে কড়াকড়ি আরোপ, আন্তর্জাতিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সার্ভার বাংলাদেশে স্থাপন, সার্ভারে রক্ষিত ডাটায় সরকারি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ- এ বিষয়গুলো নিয়ে এর মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে৷ এই আইন তৈরির দায়িত্বে থাকা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের কর্মকর্তা তারেক বরকতউল্লাহ বলেন, গত ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত এই খসড়া ওয়েবসাইটে ছিল৷ সে সময় টিআইবিসহ অনেক পক্ষের কাছ থেকে লিখিত মতামত পাওয়া গেছে৷ সেই মতামত পর্যালোচনা করে যেগুলো গ্রহণযোগ্য, সেগুলো গ্রহণ করা হবে৷ সেই পর্যালোচনার কাজ এখন চলছে৷ পাশাপাশি খসড়ায় যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, তাহলে সেগুলো অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে সংশোধন করেই আইনটি চূড়ান্ত করা হবে৷

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিনের আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নতুন এই ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট-২০২২ নিয়ে আমি চিন্তিত এই কারণে যে, আমরা যখন দাবি করেছি, ৫৭ ধারা বাতিল করতে, সরকার করেছে৷ এরপর তারা এরচেয়েও কঠিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী সবাই কিন্তু বলছেন, এই আইনের অপব্যবহার হচ্ছে৷ আমরাও এই আইনটি সংশোধনের কথা বলছি৷ এখন সেটা সংশোধন করে নতুন আইন হচ্ছে৷ ফলে আমরা ভয় পাচ্ছি, ওই জিনিসগুলোই আরও কঠিনভাবে এখানে রাখা হতে পারে৷ কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটা হয়েছে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে৷ আর এবার আইন হচ্ছে ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে৷ এখন আমার প্রশ্নটা হলো, এই আইন করা হচ্ছে জনগনের স্বার্থে, নাকি সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য?’’

আইন যখন হয়, তখন এর অপপ্রয়োগের সম্ভাবনাও থাকে: মোস্তফা জব্বার

জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যে ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট করেছি, তখন এর ব্যাপকভাবে সমালোচনাও হয়েছে৷ আমিও অস্বীকার করব না, যে এর অপপ্রয়োগ হয়নি৷ আইন যখন হয়, তখন এর অপপ্রয়োগের সম্ভাবনাও থাকে৷ এটা সরকারের করতে হয় না৷ একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে মামলা করে৷ এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে দুই দিন পরপর যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হচ্ছে, গুজব ছড়ানো হচ্ছে, অপপ্রচার হচ্ছে তার জন্য সবচেয়ে বড় প্লাটফরম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার কী দরকার নেই? এটা কি লাগামহীন ছেড়ে দেওয়া যাবে? পৃথিবীর সব দেশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে৷ বিদেশে বসে যখন যা খুশি তাই প্রচার করা হয়, এগুলো কি নিয়ন্ত্রণ করার দরকার নেই? আমাদের আসলে অপপ্রয়োগ প্রতিরোধ করা দরকার এবং অপপ্রয়োগ যাতে না হয় সেটিও নিশ্চিত করা দরকার৷’’