1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘাত, আতঙ্ক বাংলাদেশ সীমান্তে

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৮ জানুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির তীব্র লড়াই চলছে। এর জেরে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের এপারেও গুলি এসে পড়ছে।

https://p.dw.com/p/4bllG
মিয়ানমারের এমএনডিএএ-র সদস্য়রা সামরিক ঘাঁটি দখলের পর হেঁটে যাচ্ছেন
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির তীব্র লড়াই চলছে (প্রতীকী ছবি)ছবি: Handout/Kokang Information Network/AFP

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। একইসঙ্গে সীমান্ত দিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।  

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, সীমান্তরক্ষীরা অনেক আগে থেকেই সেখানে সতর্ক অবস্থানে আছেন। সরকার পরিস্থিতির ওপর বিশেষ নজর রাখছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান রোববার সীমান্তবর্তী এলাকা পরিদর্শন করে কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। 

মিয়ানমানের এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে রবিবার ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠক শেষে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, "মিয়ানমানের বিষয়ে নজর রাখছে চীন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি বর্তমান উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমরা একসঙ্গে কাজ করব।” বৈঠক শেষে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, "মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাত বন্ধ করে অস্ত্রবিরতির জন্য চীন মধ্যস্থতা করছে। রাখাইনে অস্ত্রবিরতি প্রতিষ্ঠা হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আবার আলোচনার পথ সুগম হবে।” 

রাখাইনের সংঘাতময় পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনে বাধা সৃষ্টি করছে কি না, তা জানতে চাইলে ইয়াও ওয়েন বলেন, "রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমরা এটাও জানি, প্রত্যাবাসন এখন কিছুটা সমস্যার মুখে পড়েছে।”

'মিয়ানমার নিয়ে বিজিবি সতর্ক অবস্থানে আছে'

তবে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাখাইন যদি আরাকান আর্মির দখলে চলে যায় তাহলে আমাদের জন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও বেশি কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের সরকারের এখন উচিৎ হবে দৃশ্যমান কিছু করা। সীমান্তে আমাদের যে উপস্থিতি আছে, সেটা তাদের বোঝাতে হবে। পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও চালিয়ে যেতে হবে।” 

এদিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি ও মর্টারশেল দেশের সীমান্তের মধ্যে এসে পড়ছে। শনিবারও টেকনাফ সীমান্তের এপারে নুরুল ইসলামের বসত ঘরে এসে পড়ে ওপার থেকে ছোড়া এলএমজির গুলি। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন ১ নম্বর ওয়ার্ড উলুবনিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নুরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সীমান্তের মিয়ানমারের ওপার থেকে মর্টারশেল ও ভারি অস্ত্রের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। হঠাৎ ভারি অস্ত্রের একটা গুলির শব্দ খুব কাছ থেকে শুনতে পাই। তখন দেখি আমার বসতঘরে টিনের দরজা ছিদ্র করে একটি গুলি ঢুকে পড়ে। পরে বিজিবির সদস্যরা খবর পেয়ে তারা এসে গুলিটি নিয়ে যায়।” 

স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা লালু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া, তুলাতুলি ও কানজরপাড়া সীমান্তের মিয়ানমারের ওপারে সপ্তাহজুড়ে প্রচুর গোলাগুলি চলছে। ভয়ে আমরা বাড়ি ঘরে থাকতে পারছি না এবং চিংড়ি ঘেরেও যেতে পারছি না। এখন আমাদের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে। অনেকে পরিবার দূরে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।”  

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের এখন কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো ছাড়া আর কিইবা করার আছে। তবে তাদের গুলি যে আমাদের দেশে পড়ছে, এটা শক্ত প্রতিবাদ জানানো উচিত। পাশাপাশি আমাদের সবচেয়ে বন্ধু দেশ ভারত ও চীন। তারা কিন্তু মিয়ানমার ইস্যুতে আমাদের পক্ষে না। এটাও তাদের বোঝাতে হবে। এখন রাখাইনে যে সংঘাত হচ্ছে, তাতে এক পক্ষ জিতবে, অন্যপক্ষকে পালাতে হবে। যারা পালাবে, তারা কোথায় যাবে? সেখানেই কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার সংকট। অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে যদি কোন পক্ষ এদেশে চলে আসে তাহলে আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ। পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও যাতে আর না আসতে পারে সেটাও দেখতে হবে।”  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাখাইনসহ মিয়ানমারের একটি বড় অংশএরই মধ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এসব জায়গা পুনর্দখল করতে জান্তা সরকার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় যাতে ফের রোহিঙ্গার ঢল বাংলাদেশের দিকে না আসে, সেটা নিশ্চিত করতে সীমান্তে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।  

জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিভিন্ন ফ্রন্টে বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপের তুমুল প্রতিরোধের কারণে জান্তা সরকার কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা আমাদেরও কাঁধে। নতুনভাবে যাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, এটা নিশ্চিত করতে সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে। জান্তা সরকার বা বিদ্রোহী যারাই ক্ষমতায় থাকুক, আমাদের ফোকাস হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। জান্তা সরকার বা বিদ্রোহী, কারও পক্ষে বাংলাদেশ অবস্থান নেয়নি। বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ভূমিকায় আছে। এই নিরপেক্ষতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্র জোরালো করার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।”  

বিজিবির টেকনাফ ব্যটেলিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সীমান্তে আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে।” রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কোন ঘটনা কী এখন পর্যন্ত ঘটেছে? জবাবে তিনি বলেন, "না, এখন পর্যন্ত কোন রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেনি। আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছি।” 

থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য পাঠিয়েছে দেশটির জান্তা সরকার। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে আরাকান আর্মির সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে রাখাইনের আরাকান আর্মি ও আরও দু'টি সশস্ত্র দল এক হয়ে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে একটি জোট গঠন করেছে বেশ আগে। এই জোটের যোদ্ধারা গত অক্টোবর থেকে জান্তা সেনার ওপর হামলা চালানো শুরু করে। তাদের হামলার তীব্রতায় টিকতে না পেরে জান্তা সেনারা একাধিক স্থান থেকে পালিয়ে গেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ এ রাজ্যের দখল নিতে সেখানে ফের সংগঠিতহচ্ছে জান্তা বাহিনী।  

'অস্ত্র নিয়ে কেউ এদেশে চলে এলে সেটা উদ্বেগের'

এই পরিস্থিতিতে বুধবার বিজিবি মহাপরিচালক বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিদর্শন করেন। সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে তিনি সেখানে যান। পরিদর্শনকালে বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্তে দায়িত্বরত সকল পর্যায়ের বিজিবি সদস্যদের সাথে মতবিনিময় করেন। এসময় তিনি সবাইকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সীমান্তে উদ্ভুত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেন তিনি। 

নাগরিকত্ব ছাড়া ঘরে ফিরবে না রোহিঙ্গা শরণার্থীরা