1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মৃতদেহ সরকারি খাতায় সংখ্যা হয়ে থাকে

গৌতম হোড়
১০ জুলাই ২০২০

লকডাউনের এক মাস সাতদিন পর চালু হয়েছিল শ্রমিক স্পেশাল। তাতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে ট্রেনে বা স্টেশনে মারা গিয়েছেন ১১০ জন পরিযায়ী শ্রমিক।

https://p.dw.com/p/3f5lY
ছবি: DW/M. Kumar

কিছুদিন আগের ছবি মনে পড়ে গেল। স্টেশনে শায়িত মায়ের দেহ। ছোট্ট বাচ্চা ভেবেছে মা শুয়ে আছে। খেলতে খেলতে সে মৃতদেহের ওপর বিছিয়ে দেওয়া চাদর সরিয়ে মা-কে ডাকছে। জানে না, মা আর নেই। অনেক আশা নিয়ে, অনেক দুর্দশা সহ্য করে, কষ্ট করে ওই পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেন ধরেছিলেন। যাত্রা পুরো হলো না। অথবা বলা যায়, এই জীবনের যাত্রা স্টেশনেই শেষ করে ফেললেন তিনি।

অনেকদিন আগে সুব্রত চক্রবর্তীর একটা কবিতা পড়েছিলাম, 'বালক জানে না'। 'আকাশ যে নীল নয়, তা পাখি জানে, ঘুড়ি কিছু জানে, বালক জানে না।' ছবিতে দেখা স্টেশনের ওই বালকও জানত না, সে অনাথ হয়ে গেছে। এটাও জানত না, অনাথ হওয়া কাকে বলে। সে কোথায় আছে, কীভাবে আছে, তার খবর আমরাও জানি না। সংবাদমাধ্যমও খুব নিষ্ঠুর। কোনো খবর নিয়ে সাময়িক উত্তেজনা দেখা দেয়। তারপর নতুন খবরের উত্তেজনার মধ্যে আমরা ডুবে যাই। খুব দরকার না হলে পুরনো খবরের কী হলো তার দিকে তাকাই না।

পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়েও তাই হয়েছে। লকডাউন শুরু হওয়ার পর তাঁদের কষ্ট, কয়েকশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে শুধু বিস্কিট খেয়ে ফেরার চেষ্টা, পথের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পথের মাঝেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া নিয়ে সে সময় আলোড়ন কম হয়নি। তারপর শ্রমিক স্পেশাল যখন চালু হলো সেখানে কড়ায় গণ্ডায় টিকিটের টাকা নিয়ে শ্রমিকদের ট্রেনে চড়তে দেওয়া হয়েছে। কখনও কংগ্রেস বলেছে, তারা টাকা মিটিয়ে দেবে। কখনও রাজ্য সরকার বলেছে, তারা টাকা দিয়ে দেবে। কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কেউ তাঁদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, খাবার বা জল পর্যন্ত পাননি তাঁরা। রেল বলেছে, খাবার ও জল দেওয়া হয়েছে। এক বোতল জল এবং লাঞ্চ বা ডিনার। তবে সেটা বারো ঘণ্টার বেশি যাত্রা হলে তবেই। ২৪ ঘণ্টায় দুই বার। সূত্র জানাচ্ছে, অধিকাংশ শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের গন্তব্য ছিল বিহার ও উত্তর প্রদেশ। দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর যেখান থেকে যাত্রা শুরু হোক প্রধান গন্তব্য ওই দুই রাজ্য। ফলে ট্রেন-জানজট হয়ে গিয়েছিল। মানে সব ট্রেন একই গন্তব্যে গেলে যা হয় আর কী। ট্রেন থামিয়ে রাখলে যাত্রী বিক্ষোভ হচ্ছিল। তাই অনেক ট্রেন ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। ট্রেন চলছে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতে অনেক দেরি হচ্ছে। যত দেরি তত কষ্ট। খাবার, জলেরও অভাব। ঘরে ফেরার এই যাত্রাটা আদৌ সুখকর ছিল না।

চার ঘণ্টার নোটিশে লকডাউন শুরু হয়েছিল ২৪ মার্চ। শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চলছে ১ মে থেকে। ওই একমাস সাতদিন পরিযায়ী শ্রমিকরা কেমন ছিলেন, তা নিয়ে প্রচুর খবর হয়েছে। সেই পর্বেও অনেক মানুষ মারা গিয়েছেন। বাড়ি ফিরতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় বা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পথের মধ্যেই তাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন।  তারপর ট্রেনে ও স্টেশন চত্বরে ১১০ জন মারা গিয়েছেন, যাঁরা শ্রমিক স্পেশালে ফিরছিলেন।

সংখ্যাটা একজন-দুই জন নয়, ১১০ জন। শুধু বাড়ি ফেরার তাগিদে মরিয়া হয়ে এই ট্রেনে চেপেছিলেন। বাড়ি থেকে হাজার, দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের প্রবাসে কাজ ছাড়া, নিঃস্বহয়ে তাঁরা থাকতে চাননি। তাঁরা জানতেন, আর দেরি হলে ওখানেই মারা যাবেন। ভিন রাজ্যে ভাষা আলাদা, পরিবেশ আলাদা, কোনও স্বজন নেই। গ্রামের বা রাজ্যের কয়েকজন আছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের অবস্থাও একই। ফলে সাহায্য পাওয়ার সুযোগ কম। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং সরকারি ব্যবস্থার ভরসায় আধপেটা খেয়ে কতদিন থাকা যায়?

ট্রেন চালু হলো। তাও  তাঁদের বাড়ি ফেরা হলো না। এই যে এতগুলো প্রাণ ট্রেনে বা স্টেশন চত্বরে চলে গেল, তার দায় কার? রেল বলছে, অনেকেই আগে থেকে অসুস্থ ছিলেন। খেতে না পেয়ে কেউ মারা যাননি। তাই দায়টা তাঁদের নয়। অসুস্থ পরিযায়ী শ্রমিকরা আগের অসুস্থতার জন্য মারা গিয়েছেন। তার দায় রেল নেবে না। বরং তাঁরা তো শ্রমিকদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছিলেন, যেটা নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। ভালো কাজটা শুরু করতে কেন একমাস সাত দিন দেরি হলো, তার দায়ই বা কে নেবে? উপমহাদেশে রাজনীতিতে বা প্রশাসনিক ব্যর্থতায় দায় নেওয়ার চল নেই।  করোনাকালে  শ্রমিক স্পেশাল চালানো হয়েছে, সেটাই বড় কথা। দেরিতে চালানো, তাতে ১১০ জনের মৃত্যুর দায় নিতে গেলে তো  মহা বিপদ। তার আগেও তো অনেকের মৃত্যু হয়েছে রাস্তায়। তার দায়ও তো তখন নিতে হয়। তার থেকে দায়টা লোকের ওপরে চাপিয়ে দেওয়াই ভাল। তাতে নিজেদের তো বাঁচানো যায়।

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

তাছাড়া এমন তো নয় যে, স্বাভাবিক সময়ে ট্রেনে বা স্টেশনে লোকে মারা যান না। মারা যান। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বা অন্য অসুখের জন্য মারা যান। কিন্তু সেই মৃত্যুর সঙ্গে কি পরিযায়ীশ্রমিকদের মৃত্যু এক করে দেখা যায়? বোধহয় না। কারণ, পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে লকডাউনের সময় যে কষ্ট করতে হয়েছে, পরে ট্রেন ধরতেও যে পরিমাণ হাঁটতে হয়েছে বা ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে, যেভাবে খালি পেটে দিনের পর দিন থাকতে হয়েছে, তাতে সুস্থ-স্বাভাবিক যে কোনও মানুষ অসুস্থ হতে বাধ্য। দীর্ঘদিন ধরে এই কষ্ট সহ্য করার মতো শরীরের জোর যাঁদের ছিল না, তাঁরা আর বাড়ি পৌঁছতে পারলেন না।  

সরকারি খাতায় শুধু লেখা থাকবে, স্টেশনে ও ট্রেনে এতজন লোক মারা গিয়েছিলেন। বাকি কিছু লেখা থাকবে না। শুধু সেই সংখ্যা দিয়ে আর কী জানা যাবে? সরকারি খাতায় থাকা ওই সংখ্যার মধ্যে তাঁদের কষ্টের কাহিনি চাপা পড়ে যাবে।

আর স্টেশনের ওই বালকও একদিন বড় হবে, জানবে, বুঝবে, মৃত্যু কাকে বলে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া তাঁরও আর বিকল্প কী থাকবে?