1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মৌলবাদী প্রবণতা থেকেই সাম্প্রদায়িক শব্দ বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে

সমীর কুমার দে ঢাকা
৫ মার্চ ২০২১

ভাষা নদীর স্রোতের মতো৷ আবর্জনা সেই স্রোতে ভেসে যাবে৷ সমাজ যেটা গ্রহণ করবে, সেটাই টিকে থাকবে৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপে বলছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী৷

https://p.dw.com/p/3qEqv
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীছবি: Sirajul Islam Chowdhury

তার মতে, মৌলবাদী প্রবণতা থেকেই এখন সাম্প্রদায়িক শব্দ বেশি ব্যবহার হচ্ছে৷ কোনো গোষ্ঠী যদি এটা চাপিয়ে দিতে চায় সেটা চলবে না৷ ভাষা কিন্তু ওগুলো গ্রহণ করে না৷

ডয়চে ভেলে : বাংলা ভাষায় শব্দের সন্নিবেশ করা হয় কিসের ভিত্তিতে?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বাংলা ভাষায় শব্দের সন্নিবেশ দু'টো জায়গায় হয়৷ যারা অভিধান তৈরি করেন তারা সেখানে এই শব্দগুলো নিয়ে নেন৷ আরেকটা হলো যখন কোন বড় লেখক সুন্দরভাবে কোন শব্দ ব্যবহার করেন, যেটা আগে করা হয়নি৷ তখন সেটা একটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়৷ তারা সাধারণত সৃষ্টিশীল লেখক হন৷ অভিধান প্রণেতারাও তা করেন আর সৃষ্টিশীল লেখকেরাও করেন৷ তাদের রচনার মধ্য দিয়ে নতুন শব্দ সংযুক্ত হয়৷ আমাদের বাংলা ভাষাতেও তাই হয়েছে৷ অনেক শব্দ আবার বাদও পড়ে গেছে৷ যেগুলো এখন আর ব্যবহার করা হয় না৷ তবে পাকিস্তান আমলে আরবি শব্দ বেশি ব্যবহার করার একটা চেষ্টা হয়েছিল৷ সেটা টেকেনি৷ আবার সংস্কৃত বাহুল্যও বাংলা ভাষাতে আছে৷ বাঙালি মুসলমানরা আবার সেটাকেও গ্রহণ করতে পারেনি৷ সামাজিক কারণেও গ্রহণ-বর্জনের ঘটনা ঘটে৷

‘ভাষা সেটাকেই গ্রহণ করে যেটা তার সঙ্গে মেলে’

বাংলা একাডেমির অভিধানে নতুন নতুন শব্দ দেখা যায়৷ এগুলো কিসের ভিত্তিতে নেওয়া হয়?

এটা কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে করা হয় না৷ সব অভিধানেই নতুন যেসব শব্দ প্রচলিত হয় সেগুলো মানুষের কাছ থেকে নেওয়া হয়৷ সব জায়গাতেই বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এগুলো আসে৷ তারাই নতুন নতুন শব্দের ব্যাপারে সুপারিশ করেন৷ কিন্তু বাংলা একাডেমি সেটা করে না৷ কারণ তারা কোন বিশেষজ্ঞ রাখেন নাই৷ এটা তারা পারেন নাই৷ এটার দরকার ছিল৷ একটা ভাষাকে বিকশিত করতে হলে এমন বিশেষজ্ঞ থাকতে হয়৷ তারা পরামর্শ দেবেন এই শব্দগুলো এখন ব্যবহৃত হচ্ছে, এগুলো অভিধানে সংযোজন করা প্রয়োজন৷ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে আমাদের অনেক শব্দ আছে৷ ওরা লোক রাখে, তাদের পরামর্শ শোনে৷ কিন্তু আমাদের তো কোন আয়োজন নেই৷ এই কারণে আমাদের অভিধানে খুব একটা এমন সংযোজন ঘটে না৷

ভাষাবিদদের মধ্যে শব্দ নিয়ে কোনো মতবিরোধ আছে কি-না?

এটা তো ছিল৷ একদল চেষ্টা করেছে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত বাহুল্য বজায় রাখতে৷ শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানরা এক সময় বলতেন, এই ভাষাটা আমাদের মাতৃভাষা না৷ আমাদের মাতৃভাষা উর্দু৷ মুসলমান লেখকেরাও চেষ্টা করেছেন আরবি-ফারসি ভাষা বেশি ব্যবহার করতে৷ বাংলা ভাষায় শব্দ যোগ করতে একটা বড় কাজ করে দিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম৷ তিনি অনেক আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন৷ যেগুলো প্রচলিত, মুখে মুখে ছিল কিন্তু ব্যবহৃত হত না৷ যেমন নজরুল ইসলাম খুন শব্দকে ব্যবহার করেছেন৷ খুন শব্দের অনেক অর্থ হয়৷ খুন করা, খুন মানে রক্ত, খুন হব, খুন হয়ে যাব অনেক রকম অর্থ হয়৷ এই খুন শব্দে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আপত্তি করেছিলেন৷ তখন নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, এটা নিয়ে আপত্তির কী আছে, এটা তো কসাই খানার খুন না৷ এটা আবেগ থেকে চলে আসে৷ এরকম নজরুল ইসলাম অনেক শব্দ ব্যবহার করেছেন, যেগুলো বাংলা ভাষায় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল৷ এরকম বড় প্রতিভা যখন কোন শব্দ ব্যবহার করেন তখন সেটা গ্রহণযোগ্যতা পায়৷

শব্দ কি অভিধান থেকে আসে, নাকি সমাজ থেকে বাংলা অভিধানে যায়?

ভাষা তো মানুষের মুখের ভাষা৷ শব্দ তো মানুষের মুখে থাকে৷ মুখ থেকেই অভিধানে যাবে৷ অভিধান থেকে মুখে আসে না৷ ভাষা সমাজ থেকেই অভিধানে যাবে৷ লেখকেরা এই শব্দগুলো সমাজ থেকেই নেন৷ তারা নিজেরা তৈরি করেন বা আকাশ থেকে পান তা নয়৷ এটা সমাজ থেকেই অভিধানে যায়৷ সমাজ থেকেই ভাষা সমৃদ্ধ হয়৷

ইদানিং কি সাম্প্রদায়িক শব্দগুলো বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে?

এই ধরনের শব্দ বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে সমাজের কারণে৷ সমাজে এক ধরনের মৌলবাদী প্রবণতা দেখা দিয়েছে৷ ওই দিক থেকে আবার হিন্দু শব্দও আসছে৷ হিন্দু শব্দও কিন্তু বাংলা ভাষায় ঢুকেছে৷ এগুলো আগে আমরা ব্যবহার করতাম না৷ মৌলবাদী প্রবণতা থেকেই এগুলো ব্যবহার হচ্ছে৷

ধর্মীয় শব্দ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা অভিধানে উন্মুক্ত করা আছে কী-না?

এগুলো কিন্তু ধর্মীয় শব্দ না৷ যে শব্দগুলো সামাজিকভাবে গৃহীত হয়, সেগুলোই ব্যবহার হয়৷ ধর্মীয় শব্দ হওয়ার কোন সুযোগ নেই৷ সেটা ন্যায়সঙ্গতও না৷ কোন শব্দ যদি প্রচলিত হয় সেটাই মানুষ ব্যবহার করে৷ এটা কিন্তু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না৷ কোন গোষ্ঠী যদি এটা চাপিয়ে দিতে চায় সেটা চলবে না৷ ভাষা কিন্তু ওগুলো গ্রহণ করে না৷

কেউ কেউ বাংলা ভাষায় তৎসম প্রবেশ করানোর চেষ্টা করেন৷ আবার কেউ ইংরেজি শব্দকে গুরুত্ব দেন? কারণ কী?

আমাদের দেশে যে শ্রেণিটা সর্বক্ষেত্রে কর্তৃত্ব করে, যারা আদর্শ, যাদের দেখে অন্যরা শেখে তাদের কথাবার্তার মধ্যে ইংরেজি শব্দ আসে৷ এমনকি ইংরেজি বাক্য চলে আসে৷ তখন ওইভাবে চলে৷ কিন্তু এটা ভাষা হিসেবে গৃহীত হয়নি৷ হবেও না৷ অভিধানে এটা ঢুকবে না, সাহিত্যও এটা গ্রহণ করবে না৷ অনেকে আবার আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করে৷ এমনকি আঞ্চলিক ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা করার চেষ্টা হয়েছিল৷ সেটাও টেকেনি৷ কেউ কিন্তু এটা চাপিয়ে দিতে পারেনি৷ সমাজের সকল অংশের গ্রহণযোগ্যতা ছাড়া এটা টিকতে পারবে না৷

ভাষাবিদদের এই প্রতিযোগিতা বাংলা ভাষাকে কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে?

ভাষা কিন্তু নদীর স্রোতের মতো৷ এটাকে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না৷ চেষ্টা করলেও পারবে না৷ ভাষা নিজের মতো চলবে৷ মানসম্মত ভাষাটাই টিকবে৷ এটা সামাজিকভাবেও গৃহীত৷ ওইটাই চলে আসছে৷ ওটাকে বিকৃতও করা যাবে না৷ ভাষাকে বিকৃত করা সহজ না৷ এটা তো কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্পত্তি না৷ এটাতে সকল মানুষের অধিকার আছে৷ ওই যে বললাম এটা নদীর স্রোতের মতো৷ স্রোতের সঙ্গে আবর্জনা চলে যাবে৷ এটা কেউ থামাতে পারবে না৷

নামবাচক বিদেশি শব্দ ছাড়া অন্য বিদেশি শব্দ গ্রহণ করার বিধান আছে কী?

না, নিয়ম নেই৷ অনেক শব্দ যেমন চলে গেছে৷ যেমন টেলিস্কোপ৷ আমরা তো ব্যবহার করেছি৷ এখন সেটা নেই৷ এটা কারো চাপিয়ে দেওয়া না৷ আমি আগেই তো বললাম, ইংরেজিতেও কত শব্দ আমাদের এখান থেকে নিয়েছে৷ যেমন বাজার, হাট ইংরেজি ডিকশনারিতে অনেক জায়গায় পাওয়া যায়৷ ওরা এগুলো নিয়ে নিয়েছে৷ কারণ ওরা দেখেছে, ওদের লোকেরাই এটা ব্যবহার করে৷ ভাষা ওই ধরনের রক্ষণশীল না৷ ভাষা গ্রহণ করে৷ ভাষা সেটাকেই গ্রহণ করে যেটা তার সঙ্গে মেলে৷ নতুন শব্দ এসে ভাষাকে বিকৃত করতে পারে না৷ ওগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যায়৷

বাংলা ভাষায় শব্দের ব্যবহার সহজ করার উপায় কী?

সেটা ব্যবহারের উপর নির্ভর করবে৷ সেটা নির্ভর করবে, কত ব্যবহার করছি আমরা৷ আমরা কতটা লিখছি৷ এটা মূলত সাহিত্যের লেখা৷ তার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক লেখা, বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা৷ এগুলো যত লিখব, ততই নতুন নতুন শব্দ আসবে৷ আমরা ভাষাকে যত বেশি ব্যবহার করব সেটা উপর নির্ভর করবে৷ আরেকটা কাজ জরুরি, সেটা হল অনুবাদ৷ আমরা যদি বিভিন্ন সাহিত্য থেকে অনুবাদ করি তখন দেখা যাবে, আমাদের ভাষার ধারণ ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য