1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কেন আজও জনপ্রিয় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা?

মো. আরিফুর রহমান
২৫ জুন ২০১৮

‘জনপ্রিয়তা বাড়ছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার' – শিরোনামে ২০১৫ সালে একটি খবর প্রকাশিত হয়৷ বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে৷ প্রশ্ন হলো, কেন এই চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশের জনগণ?

https://p.dw.com/p/308vM
Alternativ zur Schulmedizin - Homöopathie
ছবি: picture-alliance/ZB/H. Wiedl

সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ আক্তার জাহান মিলি বলেছিলেন, নতুন আবিষ্কৃত রোগগুলোর কথা বাদ দিলে, পুরনো অনেক রোগই প্রায় পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে, এর বিশেষত্ব এখানেই৷ বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ লোক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নেয়৷ এই গবেষণার গবেষক ডাক্তার জাহাঙ্গীর আলম বলছিলেন, ‘‘গত ১৫ বছরে এ দেশে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নেওয়া লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অন্তত চারগুণ৷''

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা কী? ১৭৯০ সালে ওষুধ বিজ্ঞানের জগতে সূচিত হয় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন৷ বিজ্ঞানী হানেমান ১৭৯৬ সালে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন ‘হোমিওপ্যাথি' নামক একটি চিকিৎসা পদ্ধতি৷ এরপর থেকেই এগিয়ে চলে নতুন ওষুধের অগ্রযাত্রা৷ হানেমানই প্রথম বলেন, ভেষজ বস্তুকে ওষুধ হতে হবে তার অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার গুণে৷ সাধারণ ভেষজ গুণগুলি থাকলেই কোনো বস্তু ওষুধ হিসেবে স্বীকৃত হবে না, যতক্ষণ না তার অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো হয়৷

একটি বস্তুর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার উন্নয়ন ঘটিয়ে যখন তা সুস্থ মানবদেহে প্রয়োগ করা হবে এবং তার ঔষধি গুণাবলীর প্রকাশ দেখা যাবে, তখন তাকে ওষুধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে৷ এভাবে কোনো বস্তুর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ডাইনামাইজেশন বা পোটেন্টাইজেশন৷ হোমিওপ্যাথিতে ওষুধ হচ্ছে শক্তির আধার৷ কোনো ওষুধ বস্তুর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার উন্নয়ন ঘটিয়ে যখন শক্তিকরণ করা হবে, তখন তা ওষুধে রূপান্তরিত হবে৷ এ ওষুধ যখন রোগীর দেহে প্রয়োগ করা হবে, তখন তা আরোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে৷ এভাবে অনেক সাধারণ ভেষজগুণাবলিহীন বস্তুও হোমিওপ্যাথিতে ওষুধে রূপান্তরিত হয়ে রোগীর জন্য আরোগ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷

আমরা বলছি, বাংলাদেশ অ্যালোপ্যাথিক ওষুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ৷ আমাদের দেশীয় ওষুধ খাতে  ঘটছে একের পর এক বিপ্লব৷ দেশের চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধই উৎপাদন হয় দেশে, বিশ্বের প্রায় ১১৩টি দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ৷ এত কিছুর পরও দেশে প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার পাশাপাশি আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি জনপ্রিয় হচ্ছে৷

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এখন দেশের ২৭৮টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ১৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করে৷ এছাড়া দেশের ২৬৬টি ইউনানি, ২০৫টি আয়ুর্বেদিক, ৭৯টি হোমিওপ্যাথিক ও ৩২টি হারবাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ৮৫০ কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন করে থাকে৷ বাজারটা দেখলেই বুঝা যায়, এসব চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের চাহিদা বাড়ছে

কেন বাড়ছে চাহিদা? একটা উদাহরণ দেই, মনে করুন, একজনের একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে৷ অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের কাছে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো৷ ডাক্তার কী বলবেন? অবশ্যই রোগীকে বলবেন, তাঁর কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে৷ এই অপারেশনের জন্য প্রয়োজন টাকা৷ টাকার পরিমাণটা কত হতে পারে আর কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে একবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখুন৷ তো কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলেই যে ভালো হবে তার নিশ্চয়তা নেই৷

যার টাকা নেই, সে তখন বিকল্প রাস্তা খোঁজে এবং শেষ পর্যন্ত হাজির হয় আয়ুর্বেদিক, ইউনানি কিংবা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসালয়ে৷ সেখানে অল্প টাকায় চিকিৎসা হয়, ফলাফল কী হবে সেটা মানুষ ভাবে না৷ চিকিৎসা শুরু করে, কেননা, কেউ হয়ত এই চিকিৎসায় ভালো হয়েছিল – এমন উদাহরণ তো আছেই!

শুধু কি এই কারণ? মানুষের কিছু গোপন রোগ আছে, যা সে কাউকে বলতে ভয় পায়৷ এসব গোপন রোগের গোপন সমাধান দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎগতিতে গড়ে উঠেছে হারবাল কিংবা হোমিও চিকিৎসালয়৷ এ চিকিৎসায় বিতরণ করা হয় লিফলেট৷ এ সব লিফলেটের নীচে লেখা থাকে বিভিন্ন দাওয়াখানা, হারবাল ও হোমিও চিকিৎসালয়ের ঠিকানা৷

ভাগ্য ফেরানোর কারিগরদের নামের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে অদ্ভুত ধরনের ডিগ্রি ও মেডেল প্রাপ্তির ইতিহাস৷ অর্থাৎ মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এরা ব্যবসা করে যাচ্ছে৷ ভাগ্য ফেরানোর নামে গড়ে ওঠা দাওয়াখানা, হারবাল ও হোমিও চিকিৎসালয়ের অধিকাংশের ট্রেড লাইসেন্স নেই৷ তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবার কিংবা দেখার কেউ নেই৷

এটা কি বিজ্ঞানসম্মত ‘Like cures Like' (অর্থাৎ, যা রোগ সৃষ্টি করে তা-ই রোগ সারায়) এবং লঘুকরণেই শক্তি – এই দুই মন্ত্রে শতাব্দীব্যাপী শত বিতর্কের পরেও টিকে আছে হোমিওপ্যাথি৷ কিন্তু অবিশ্বাস্য বিষয়টি হচ্ছে, হোমিওপ্যাথি ঔষধ কিভাবে কাজ করে, এর উত্তর এখনও বিজ্ঞানের কাছে নেই৷

মো. আরিফুর রহমান ফাহিম
মো. আরিফুর রহমান ফাহিম, লেখক, ফার্মাসিস্ট এবং পিএইচডি গবেষক, শিজুওকা ইউনিভার্সিটি, জাপানছবি: privat

নানারকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় হোমিওপ্যাথির অকার্যকারিতা প্রমাণিত হবার পরেও আধুনিক চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা, চিকিৎসা ব্যায়, শিক্ষার অভাব ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথি চিকৎসা ব্যপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে৷ বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের নিযুক্ত করা হচ্ছে এবং হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ চালানো হচ্ছে৷ 

এ বছর ঢাকায় প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন, ইউনানি, আয়ূর্বেদ, হারবাল ও হোমিওপ্যাথি বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন৷ ২০১৮ সালের ১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সিনেট ভবনে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ আয়োজক কে ছিল, জানেন? ঢাবির ফার্মেসি অনুষদ! এতে বিশ্বের মোট ৩২টি দেশের ৫০ জন, ভারতের ১০০ জন এবং বাংলাদেশের ৬৫০ জনসহ মোট ৮০০ জন শিক্ষাবিদ গবেষক, শিক্ষার্থী, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন৷ তাই আপনি যদি এগুলো বিজ্ঞানসম্মত কিনা – এই প্রশ্ন করেন, তাহলে লোকজন কি আপনার কথা বিশ্বাস করবে? 

এটা সত্য, বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঔষুধি গাছগাছড়ার উপাদান দ্বারা তৈরি বহু ওষুধ অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পাশাপাশি রোগ নিরাময়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কার্যকর আবদান রাখছে৷ তবে ইউনানি ও আয়ূর্বেদিক শিল্প নিয়ে প্রতারক ওষুধ প্রস্তুতকারক ও ভুয়া কবিরাজদের দাপটে আসল ওষুধ এখানে কার্যকর করা যাচ্ছে না৷ যানবাহন ও রাস্তাঘাট নিশ্চয়ই ওষুধ বিক্রির স্থান হতে পারে না? 

আসল প্রতিষ্ঠানের চেয়ে প্রতারক বেশি৷ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কালো তালিকাভুক্ত অর্ধশত ইউনানি ও আয়ুর্বেদি প্রতিষ্ঠান  রয়েছে, যারা জনসাধারণের সঙ্গে একের পর এক প্রতারণা করে যাচ্ছে৷ সব জটিল রোগের ওষুধ উৎপাদনকারী এ সব প্রতারক প্রতিষ্ঠান রাজধানীসহ সারাদেশে ইউনানি ও আয়ুর্বেদি ওষুধের নামে বছরের পর বছর রমরমা বাণিজ্য করছে৷

Spirulina Tabletten
ছবি: Colourbox

১৯৮২ সালের ওষুধ অধ্যাদেশের ১৪ ধারা অনুসারে যে কোনো ধরনের ওষুধ বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন প্রচার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও ওষুধ প্রশাসনকে কোনো তোয়াক্কা না করে কালো তালিকাভুক্ত এসব প্রতিষ্ঠান অনেক আগ থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছে৷ রেজিস্টার্ড কোম্পানিগুলোর মধ্যে নাকি ২০টির ওষুধ গুণগত মানের৷ তাহলে বাকিগুলো কী করছে?

নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থের বিনিময়ে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে মন আকৃষ্ট করছে৷ আকর্ষণীয় এসব বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে স্বল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষ প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছে৷ রাজধানী জুড়ে গড়ে উঠেছে এই প্রতারকদের নেটওয়ার্ক৷ রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় এর সদস্যরা ছোট ছোট কার্ড, লিফলেট বিতরণ করে মানুষকে আকৃষ্ট করছে৷ এর থেকে মুক্তির উপায় ওষুধ প্রশাসনই ভালো বলতে পারবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য