1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোগা থেকে রোগী হয়ে ওঠা তরুণ-তরুণীদের বয়স কমছে

২২ অক্টোবর ২০০৯

মেয়েরা যখন শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে পা দেয় অথবা আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠতে থাকে, তখন তাদের সৌন্দর্যসচেতন হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক৷ নারীত্বের প্রথম বিকাশও ঘটে সে সময়ে৷

https://p.dw.com/p/KCmR
ছবি: AP

তাই না খেয়ে, না দেয়ে - নিজেকে আরো সুন্দর করে তুলতে চায় সে৷

সংকোচে, আনন্দে - নিজের মধ্যে জন্ম নেওয়া সৌন্দর্যে সে তখন নিজেই বিস্মিত হয়৷ অথচ, বিশ্বায়ণের এই যুগে, সৌন্দর্যের মাপ-কাঠিও যে আগে থেকেই ঠিক করা রয়েছে৷ তাই সে প্যারিস ভিত্তিক ফ্যাশন পত্রিকা ‘ভোগ'-ই হোক, অথবা কলকাতার ‘সানন্দা' - সব ক্ষেত্রেই কিন্তু রোগা, ছিপছিপে মেয়েদের কদর বেশি৷ রুবেনেস্ক, বা মোটা মেয়েদের যে আজ আর কেউ-ই পছন্দ করেন না৷ আর তাই, ১০-১১ বছর বয়স থেকেই মেয়েরা হয়ে উঠে ফ্যাশন সচেতন৷ যে সময় সুসম এবং পুষ্টিকর খাদ্য তাদের জন্য অত্যাবশ্যক৷ সে সময়, না খেয়ে বা অল্প খেয়ে অনেকক্ষেত্রেই নানা রকম রোগ বাধিয়ে বসে তারা৷ রোগা হওয়ার এতটাই আকাঙ্খা তাদের৷

জার্মানিতেও যার ব্যাতিক্রম চোখে পড়ে না৷

IAA Frankfurt Flash-Galerie
সাধারণভাবে প্রফেশনাল মডেল মানেই হলো : রোগা-পাতলা, লম্বা আর একটু ভিন্ন চাহনির!ছবি: DPA

জার্মান তরুণীদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বয়ঃসন্ধীর সময় থেকেই একটি অদ্ভুত রকম ‘ডায়েট' শুরু করে৷ তাই জার্মানির ‘গিমনাজিয়াম' বা উচ্চ-বিদ্যালয়গুলির কমপক্ষে ৩০% ছাত্রীর মধ্যে দেখা যায় খাওয়া-দাওয়া বিষয়ক অসুস্থতা৷ পূর্বাঞ্চলের ইয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, রোগা হতে হতে রোগী হয়ে ওঠা এই তরুণ-তরুণীদের বয়স আরো কমছে৷ অর্থাৎ, আগে যে বয়সের ছেলে-মেয়েরা রোগা হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগতো, এখন তার থেকে অনেক অল্প বয়সের ছেলে-মেয়েরা শুরু করে দিচ্ছে ‘ডায়টিং'৷ সকলেরই এক ইচ্ছে - ফিগার হতে হবে ফ্যাশন-ম্যাগাজিনের মডেলদের মতো৷

ব্যাসিক স্ট্যাটিসটিক্স ৩৪-২৮-৩৬ : আর না হলেই যে মুখ ভার !

১৫ বছর বয়সী কিরা লেমান-এর কথায়, ‘‘না, চেহারার একটা গুরুত্ব আছে বৈ কি ! আমাদের স্কুলে যেমন, যারা রোগা-পাতলা আর সুন্দর ফ্যাশনদুরস্ত সাজ-পোশাক করে, তাদেরই বন্ধু বা বান্ধবী রয়েছে৷ অথবা নিজে মোটা হলেও, তোমার যদি সুন্দরী বা স্টাইলিশ বান্ধবী থাকে - তাহলেও তুমি পার পেয়ে যেতে পারো৷ কিন্তু, কারুর যদি নিজের প্রতি, নিজের চেহারার প্রতি বিন্দুমাত্র গরজ না থাকে, আর তারওপর সে যদি মোটা হয় - তবে স্কুল শুদ্ধ সবাই তাকে ক্ষেপিয়ে মারে৷ ওড়ায় মজা৷''

কিরা অবশ্য ফ্যাশন সচেতন হলেও, নিজের ফিগারের ব্যাপারে অতটা যত্নশীল নয়৷ কিরার কথায়, ‘‘এতো মেপে-ঝেপে ক্যালরি চার্ট করে খাওয়া-দাওয়া করতে আমি পারি না৷ আমার যা ফিগার - সেটাকেই আমি মেনে নিয়েছি৷'' কিরা মেনে নিলেও, তার বান্ধবী সান্দ্রা হেরজগ কিন্তু বললো অন্য কথা৷ সান্দ্রার কথায়, ‘‘একটু ভালো, একটু স্টাইলিশ পোশাক-আশাক পড়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ৷ কিন্তু, ভালো ফিগার না থাকলে - ভালো পোশাকে কি আর মানায় ? এই যেমন, তুমি মোটা - অথচ বিকিনি পড়ে সুইমিং পুলে ঘুড়ে বেড়াচ্ছো৷ আচ্ছা বলুন তো - সেটা কেমন লাগবে দেখতে ?''

অল্প খাওয়া, আর নিয়মিত শরীরচর্চা করা : এটাই এখন ট্রেন্ড

ভালো ফিগার, ভালো স্বাস্থ্য মানেই যখন ছকে-বাঁধা নিয়ম আর কতকগুলি পরিসংখ্যান - তখন দেড়-দু ইঞ্চি বেশি মাংসপেশী থাকার দুঃখ সান্দ্রার মতো মেয়েদের তো হবেই৷ তা না হলে, সান্দ্রা কি আর এ কথা বলে ? সান্দ্রা জানায়, ‘‘হ্যাঁ, আসলে আমি আরো একটু রোগা হতে চাই৷ বেশি না৷ মাত্র এই টুকু৷ মানে কম করে হলেও আরো পাঁচ কেজি৷ তাহলেই আমি নানা রকম স্টাইলিশ, আধুনিক পোশাক পড়তে পারবো৷ আর দেখতেও খারাপ লাগবে না৷ এর জন্য আমি নিয়মিত ‘ফিটনেস স্টুডিও'-তে যাচিছ৷ আগের তুলনায়, খাওয়া-দাওয়াও করছি অনেক কম৷''

Models auf der London Fashion Week
সকলেরই এক ইচ্ছে - ফিগার হতে হবে ফ্যাশন-ম্যাগাজিনের মডেলদের মতো (ফাইল ফটো)ছবি: picture-alliance / dpa

অল্প বয়সীদের মধ্যে এটাই একরকম ট্রেন্ড হয়ে গেছে৷ অল্প খাওয়া, আর নিয়মিত শরীরচর্চা করা৷ যা বহুক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে মাত্রাতিরিক্ত৷ অনেকক্ষেত্রে না খেতে খেতে, তারা রোগা হয় ঠিকই - কিন্তু একই সঙ্গে হয়ে পড়ে অসুস্থ৷ যেমন ২০ বছর বয়স্ক কাটয়া শেরার৷ তার কথায়, ‘‘সত্যি বলতে কি - প্রথমদিকে এটা আমি বুঝতেই পারি নি৷ আমি রোগা হচ্ছি - সেটাই ছিল আমার কাছে বড় বিষয়৷ আর একটু, আরো একটু রোগা হতে চাইতাম প্রতিদিন৷ আর এভাবেই একদিন আমি লক্ষ্য করলাম যে, আমার ওজন, আমার উচ্চতা এবং বয়েসের তুলনায় বেশ খানিকটা কমে গেছে৷ সেখানেই শেষ নয়৷ বুঝতে পারলাম - আমি আর আগের মতো সঠিক পরিমাণে খেতে পারি না৷ খেলেই সব বমি হয়ে যায়৷''

বুলিমিয়া ও অন্যান্য ‘ইটিং ডিস-অর্ডার'-এ ভুগছে জার্মান তরুণীরা

রোগা হতে গিয়ে জার্মানির বহু তরুণীই আজ নানা ধরনের পেটের সমস্যা, বুলিমিয়া এবং অন্যান্য ‘ইটিং ডিস-অর্ডার'-এ ভোগে৷ স্নায়বিক ক্ষুধামন্দায় আক্রান্ত এ সব নারী শরীর পাতলা করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে উপোস করে৷ ইচ্ছে করে বমি করে৷ এরা বিশ্বাস করে যে, তারা না খেয়ে থেকে শরীরকে যথেষ্ট পাতলা করতে সক্ষম হবে, সক্ষম হবে সুন্দর ফিগারের অধিকারী হতে৷ দুর্ভাগ্য এটাই যে, এদের পাঁচজনের মধ্যে একজনের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় অথবা তারা মারা যায় অপুষ্টির সঙ্গে জড়িত জটিলতার কারণে৷ তবে ক্ষুধামন্দা সাইকোথেরাপি বা পেশাদারি ডাক্তারি পরামর্শে ভালো হওয়া সম্ভব৷

মনোবিজ্ঞানী ড. কারমেন ব্লাশকে জানান, ‘‘৬০-এর দশকে পশ্চিমের দেশগুলি নারী সৌন্দর্যের যে মাপকাঠি এঁকে দিয়েছিল - বিশ্বের অগুন্তি নারী এখনও সে জায়গাতেই পৌঁছোতে চেষ্টা করে চলেছে৷ রোগা, ছিপছিপে হওয়ার বাসনা তাই তাদের নিরন্তর৷ সেটাই তাদের কাছে ‘আইডিয়েল'৷ মিডিয়া, ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলিতেও বারে বারে সেটাই তুলে ধরা হচ্ছে, দেখানো হচ্ছে৷ অথচ, তার সঙ্গে স্বাস্থ্যের ব্যাপারটাকে কোনদিনই গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়নি, হচ্ছে না৷''

কি বলছে জার্মানির শীর্ষস্থানীয় মহিলা বিষয়ক পত্রিকা ‘ব্রিগিটে' ?

বেশ কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে কিশোরীদের মধ্যে এহেন রোগা হওয়ার ট্রেন্ড-কে ঘিরে শুরু হয়েছে নানা আলাপ-আলোচনা৷ কিন্তু সম্প্রতি, জার্মানির সর্বাধিক বিক্রিত মহিলা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘ব্রিগিটে' পেশাদার মডেলদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে এবার একটু ভিন্ন পথে হাঁটতে চাইছে৷ তার মানে ? দাঁড়ান, একটু খুলে বলি৷ সাধারণভাবে প্রফেশনাল মডেল মানেই হলো : রোগা-পাতলা, লম্বা আর একটু ভিন্ন চাহনির ! বলা হয়ে থাকে, কাঙ্ক্ষিত পোশাক বা পণ্যের সঙ্গে তার উপস্থিতি যেন হয় অন্য সবার থেকে আলাদা৷ সে যেন নজর কাড়ে সব শ্রেণীর মানুষের৷ অনেকটাই রূপকথার মতো৷

Flash-Galerie Mailand Fashion Week
‘রোগা, ছিপছিপে হওয়ার বাসনা তাই তাদের নিরন্তর’ছবি: AP

কিন্তু, ম্যাগাজিনটির প্রধান সম্পাদক আন্দ্রেয়াস লেব্যার্ট বললেন, ‘‘মডেলদের মধ্যে রোগা হওয়াটাই ছিল এতোদিনকার ট্রেন্ড৷ আরো রোগা, আরো রোগা - হতে চায় সবাই৷ সব মেয়েরই এই এক উদ্দেশ্য৷ এর পরিণতি যে ভয়ংকর - তা তো বলাই বাহুল্য৷ তাই ২০১০ সাল থেকে আমরা আর পেশাদার মডেলদের সঙ্গে কাজ করবো না৷''

মোটা মেয়েরাও এবার স্থান পাবে ফ্যাশন ম্যাগাজিনে

অর্থাৎ, ২০১০ সালে ‘ব্রিগিটে' পত্রিকার জন্য মডেল হবেন তাঁরাই, যাঁরা ‘শরীরের হাড় দেখানোর চেয়ে' ‘নিজের পরিচয়ে বেশি পরিচিত'৷ অর্থাৎ, নামি মহিলাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন অনামা মেয়েরাও৷ এমনকি, এর জন্য রোগা না হলেও চলবে৷ কিরা লেমান-এর কথায়, ‘‘এটা দারুণ একটা খবর৷ কেন না এবার, কুমড়ার মতো মোটা একটা মেয়েও ফ্যাশন ম্যাগাজিনে তার জায়গা করে নিতে পারবে৷ এভাবে একটা সময় হয়তো মোটা হওয়াটা আর হয়তো অস্বাভাবিকতার মধ্যে পড়বে না৷ একটু মোটা হলেই কেউ আর ভাববে না : ‘আমি অস্বাভাবিক, আমি কুৎসিত' !''

উল্লেখ্য, সম্প্রতি ‘ফোকুস' নামক নিউজ ম্যাগাজিনে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশান ডিজাইনার কার্ল লাগারফেল্ড বলেছেন যে, শরীরের ভাঁজ বোঝা যায় এমন কোন মডেলের জায়গা নাকি ব়্যাম্পে নেই৷ তাঁর কথায়, ‘‘কেউই মোটা মহিলাদের দেখতে চাননা''৷ শুধু তাই নয়, ‘‘হালকা পাতলা গড়নের মডেলরা কুৎসিত এটি ঠিক নয়৷ বিশ্বের ফ্যাশন জগৎটা স্বপ্ন এবং মায়ার৷ তাই ব্রিগিটে পেশাদার মডেলদের আর স্থান দেবে না - এ বক্তব্য হাস্যকর৷''

প্রতিবেদক: দেবারতি গুহ

সম্পাদনা: আবদুস সাত্তার