1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৮ ডিসেম্বর ২০১৭

২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হয়ে ৬ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নেন বাংলাদেশে৷ পরবর্তীতে এই শরণার্থীদের বাংলাদেশ থেকে ফেরত নিতে একটি চুক্তি সই করে মিয়ানমার৷ কিন্তু রোহিঙ্গারা কীভাবে যাবে?

https://p.dw.com/p/2pU4v
রোহিঙ্গা শরণার্থী
ছবি: DW/ P. Vishwanathan

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে যে জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাবে না৷ তাদের কথা, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব এবং স্বাধীনভাবে সেখানে অবস্থান নিশ্চিত করার পরই কেবল তাঁদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া সম্ভব৷

জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের জোর করে মিয়ানমারে পাঠানো যাবে না৷ যখন তাঁরা নিরাপদ বোধ করবেন, কেউ যখন তাঁদের জোর করে কোথাও যেতে বাধ্য করবে না, কেবল তখনই তাঁরা নিজের দেশে ফিরে যাবেন৷''

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জেইদ রাদ আল-হোসাইন জেনেভোয় একটি বিশেষ মানবাধিকার অধিবেশনে বলেন, ‘‘কোনোভাবেই তাড়াহুড়ো করে পূর্ণ প্রস্ততি ছাড়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না৷ কাউকেই তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফেরত পাঠানো যাবে না৷ যদি সেখানে তাঁদের নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত না হয় এবং তাঁরা মুক্ত বোধ না করেন, তাহলে তাঁদের ফেরত পাঠানো যায় না৷''

গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়, মূলত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে৷ সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, মিয়ানমার ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও এ বছরের ২৫ আগস্টের পরে যাঁরা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন তাঁদের ফেরত নেবে৷ দু'মাসের মধ্যে ফেরত নেয়ার এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা৷ জানা গেছে, মিয়ানমারে ফেরত নেয়ার পর রোহিঙ্গাদের প্রথমে সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হবে৷

এই সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের চুক্তির আলোকে৷ এবারের সমঝোতা স্মারক মিয়ানমার শেষ পর্যন্ত মানলে বাংলাদেশ থেকে তারা সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা ফেরত নেবে৷ কিন্তু বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে সাড়ে ১০ লাখ৷ অর্থাৎ ২০১৬ সালের আগে আসা তিন লাখ রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার কোনো কথা চুক্তিতে নেই৷

দু'মাসের মধ্যে ফেরত নেয়া শুরু হলেও, দিনে কতজন করে ফেরত নেয়া হবে আর কতদিনের মধ্যে ফেরত নেয়া হবে, তার কোনো সময়সীমা নেই৷

এছাড়া ১৯৯২ সালের চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিক মর্যাদা দেয়ার বিষয়টিও নেই৷ ঐ চুক্তি অনুসারে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে সেখানকার সমাজে অন্তর্ভুক্তির কথা ছিল৷ তবে রোহিঙ্গাদের অধিকারসহ মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের উল্লেখ ছিল না৷

‘এখনো রাখাইনে নির্যাতন চলছে’

এবারের চুক্তিতে ফেরত নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রথমে অস্থায়ী পুনর্বাসন ক্যাম্পে রাখার কথা বলা হয়েছে৷ এরপর তাঁদের ফেলে আসা ঘরবাড়ি বা অন্য কোথাও পুনর্বাসন করা হবে৷ কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি এবারও৷ প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী পুড়িয়ে দেয়া ঘরবাড়ি সরকারি সম্পদ৷

এর আগে ১৯৯২ সালে দু'দেশের মধ্যে যে সমঝোতা হয়, তার অধীনে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে মাত্র ২ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেয় মিয়ানমার৷ আর ১৯৭৮ সালে যে চুক্তি হয়, তার অধীনে ছ'মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিয়েছিল মিয়ানমার৷ এবারের সমঝোতা ১৯৯২ সালের চুক্তির আলোকে করায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া নির্দিষ্ট সময়ের দিকে চলে গেল৷

২৩ নভেম্বরের চুক্তির পর এর নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ তারা বলছে, মিয়ানমারে যেহেতু রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা হয় তাই এই অবস্থায় তাঁদের ফেরত পাঠানো ‘অকল্পনীয়'৷ রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখনো যাঁরা মিয়ানমারে রয়ে গেছেন, তাঁদের অবস্থা বন্দি শিবিরে (কনসেনট্রেশন ক্যাম্প) থাকার মতো৷

ওদিকে রোহিঙ্গাদের এই ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সংগঠন বা কোনো মানবাধিকার গ্রুপ অংশ নিচ্ছে না৷ রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)-র প্রধান অধ্যাপক সি আর আবরার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা না চুক্তি, না সমঝোতা স্মারক৷ আমার মনে হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ তার ঘোষিত অবস্থান থেকে সরে এসেছে৷ বাংলাদেশ আগে বলেছিল, একটি ন্যূনতম সময়ের মধ্যে এঁদের ফিরিয়ে নিতে হবে৷ রোহিঙ্গাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে৷ এছাড়াও আরো কিছু শর্ত থেকে বাংলাদেশ সরে এসেছে বলেই মনে হচ্ছে৷ এখানে রোহিঙ্গাদের যে ‘ভেরিফিকেশন প্রসেস'-এর কথা বলা হয়েছে, তাতে কতজন রোহিঙ্গা পরিচয় নিশ্চিত করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷''

‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই প্রক্রিয়ায় তেমনভাবে যুক্ত করা হয়নি’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই প্রক্রিয়ায় তেমনভাবে যুক্ত করা হয়নি৷ আর ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ একবারেই নেই৷ তার ওপর মিয়ানমারে ফেরার পর তাঁদের অবস্থা আন্তর্জাতিকভাবে ‘মনিটরিং' করার জন্য কোনো ব্যবস্থাও এবারের চুক্তিতে নেই৷ ফলে আমার মনে হয় না যে, সঠিকভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে বা হবে৷''

মিয়ামনারে বাংলাদেশের সাবেক ডিফেন্স এটাশে মেজর জেনারেল শহীদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১২টি স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক এনজিও এরইমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা রোহিঙ্গাদের এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নাই৷ রোহিঙ্গাদের এখান থেকে নিয়ে মিয়ানমার যে তাঁদের মংডু ক্যাম্পে রাখবে, এটা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়৷ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা এবং পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত হলেই কেবল তারা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে, অন্যথায় নয়৷ ইউএনএইচসিআরও কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই অবস্থায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷ অথচ ১৯৯২ সালে ইউএনএইচসিআর এবং আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ছিল৷ এবার কিন্তু কেউ নেই৷''

তিনি বলেন, ‘‘এখনো কিন্তু রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছে৷ এখনো রাখাইনে নির্যাতন চলছে৷ সংবাদমাধ্যম তাঁদের নির্যাতন, ধর্ষণের কথা প্রকাশ করছে৷ অর্থাৎ পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ৷''

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ সরকার বলছে, একদিন আগে আইনমন্ত্রীও বলেছেন যে ‘ফুল রাইট' ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হবে না৷ কিন্তু এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে ফেরত পাঠানোর এই প্রক্রিয়া তো কেউ মেনে নেবে না৷ আমরা বলেছিলাম এবারের চুক্তিটি যেন ১৯৯২ সালের চেয়ে ভালো হয়৷ কিন্তু বাস্তবে এবারের চুক্তিটি ১৯৯২ সালের চেয়েও খারাপ হয়েছে৷''

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রেজিস্টার্ড ক্যাম্প দু'টি – কক্সবাজারের কুতুপালং ও নয়াপাড়া৷ এই দু'টি ক্যাম্পে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করেন৷ এছাড়া লেদা, ও কুতুপালং এলাকায় আরো কয়েকটি ‘আনরেজিস্টার্ড' ক্যাম্প আছে৷ ২৫ আগস্ট থেকে যাঁরা আসছেন তাঁদের ঠাই হয়েছে কুতুপালং-এর নতুন অস্থায়ী ক্যাম্পে৷ নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও উচ্ছেদের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ ছাড়াও সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর আরো অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন৷

১৯৭৮ সালে মিয়ানমারে অবৈধভাবে বসবাসরত ‘বিদেশি' নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো হয়৷ কিন্তু মূল ‘টার্গেট' ছিল মুসলিম রোহিঙ্গাদের তাড়ানো৷ ১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ধর্মীয় দাঙ্গার শিকার হন রোহিঙ্গা মুসলমানরা৷ এরপর ২০১২ সালে আবারও দাঙ্গার শিকার হন তাঁরা৷ গত বছরের অক্টোবর মাসে চলে আরেক দফা নির্যাতন৷ ঐ সময় প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন৷ তারও পরে ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা এসেছেন বাংলাদেশে৷

এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য