1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লকডাউনে চরম সংকটে ভারতের যৌনকর্মীরা

স্যমন্তক ঘোষ নতুন দিল্লি
৭ এপ্রিল ২০২০

করোনা সংক্রমণ এবং লকডাউনের ফলে খাবার জুটছে না ভারতের যৌনকর্মীদের। দিল্লি, কলকাতা-- সর্বত্রই এক অবস্থা।

https://p.dw.com/p/3aaBZ
ছবি: picture-alliance/dpa

বয়স ২৩। নেহা (নাম পরিবর্তিত) কাজ করেন দিল্লির জি বি রোডে। কলকাতায় যেমন সোনাগাছি, দিল্লির জি বি রোডও তেমনই বিখ্যাত যৌনপল্লির জন্য। যদিও আকারে এবং বহরে সোনাগাছি থেকে অনেকই ছোট। তবে নেহা জি বি রোডে থাকেন না। ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন মুনিরকায়। হরিয়ানা থেকে কাজের খোঁজে দিল্লি এসেছিলেন চার বছর আগে। বাবার মৃত্যুর পরে। সংসারে এখন তিনিই একমাত্র রোজগেরে। এক ভাই এবং এক বোনের পড়ার খরচ, মায়ের ওষুধ সবই তাঁর দায়িত্ব। কিন্তু এ মাসে নেহা টাকা পাঠাতে পারেননি বাড়িতে। ভাড়া বাড়ির টাকাও মেটাতে পারেননি। করোনা-লকডাউনে কাজ বন্ধ।

ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে কান্নার শব্দ। নেহা বলছেন, ''এ ভাবে চলতে থাকলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। বাড়িতে কেউ জানে না আমি কী কাজ করি। এমনকি, বাড়িওয়ালাও নন। সকলেই জানেন, ছোটখাটো একটা কোম্পানিতে সেলসের কাজ করি। বাড়িওয়ালা বলেছেন, এ মাসের ভাড়া সামনের মাসে দিলেও চলবে। তবে সুদসহ মেটাতে হবে। কিন্তু তাই বা দেবো কী করে? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।''

প্রথমবারের মতো এক যৌনকর্মীর জানাজা হলো

নেহা একা নন। এই মুহূর্তে ভারতের কয়েক লক্ষ যৌনকর্মীর একই পরিস্থিতি। পরিসংখ্যান বলছে, শুধুমাত্র দিল্লির জি বি রোডেই প্রায় পাঁচ হাজার যৌনকর্মী কাজ করেন। তার মধ্যে একটা বড় অংশ বাইরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন। জি বি রোডের যৌনপল্লিতে এসে কাজ করে ফিরে যান নিজেদের বাড়ি। যৌনপল্লির কুঠিতে থাকেন হাজার দেড়েক কর্মী। তাঁদের পরিস্থিতিও একই রকম। হাতে টাকা নেই, হেঁসেলে খাবার নেই, নেই খরিদ্দার।

কুঠিতে থাকেন শবনম (নাম পরিবর্তিত)। ফোনে সাংবাদিককে তিনি জানান, সাধারণত সন্ধে ছয়টার পরে সাজগোজ করে কাজ শুরু করেন তিনি। রাত নয়টা থেকে শুরু হয় মুজরো। অর্থাৎ, নাচ করেন শবনম। তা থেকেই দিনে হাজার দুয়েক টাকা রোজগার হয়। কখনও কখনও খুব প্রয়োজন পড়লে কুঠিতে বাবু নিয়ে আসেন। দুই সন্তানের মা শবনমের পরিস্থিতিও তথৈবচ। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ‘‘আট মাসের সন্তানের জন্য আর তিন দিনের খাবার আছে। তারপর কী হবে তিনি জানি না। নিজে একবেলা খেয়ে থাকছি। কিন্তু সন্তানকে তো আর একবেলা খাইয়ে রাখতে পারবো না!’’

ত্রাণ যাচ্ছে। দিল্লি সরকারের পক্ষ থেকেও সামান্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ত্রাণ দিচ্ছে বেশ কিছু এনজিও। দীর্ঘ দিন ধরে দিল্লির যৌন কর্মীদের নিয়ে কাজ করছে 'কাট কথা' স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংস্থার কর্মী অনুরাগ গর্গ ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে আবেদন করা হয়েছিল যৌনকর্মীদের ত্রাণে সাহায্য করার জন্য। অনেকেই সাহায্য করেছেন। প্রায় ৮০০ যৌনকর্মীর কাছে আমরা ত্রাণ পৌঁছে দিতে পেরেছি। কিন্তু একই সঙ্গে স্বীকার করছি, যা দিতে পেরেছি, তাতে খুব বেশি দিন তাঁদের চলবে না। এরপরে কী হবে জানি না।’’

অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অফ সেক্স ওয়ার্কার্সের আধিকারিক অমিত কুমার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘৩০ শতাংশ যৌন কর্মী তাঁদের গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা এখনও দিল্লিতে আছেন, তাঁদের পরিস্থিতি ভয়াবহ। দু'বেলার খাবার নেই।'' অমিত জানিয়েছেন, ‘‘প্রায় পাঁচ হাজার যৌনকর্মী কাজ করেন জি বি রোডে। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হয় সেখানে। গত ২১ মার্চ থেকে কার্যত তা শূন্যে পৌঁছেছে। লক ডাউন শুরু হওয়ার পরে কোঠি সম্পূর্ণ বন্ধ। সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ালেও যৌন কর্মীদের দিকে সে ভাবে হাত বাড়ায়নি।’’ অমিতের কথায়, ‘‘এ ভাবে চলতে থাকলে সত্যি সত্যিই তাঁদের আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।'' বস্তুত, দিল্লির মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন স্বাতী মালিওয়াল এর মধ্যেই দিল্লি সরকারের কাছে যৌনকর্মীদের পরিস্থিতি বিবেচনা করার জন্য একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

এ তো গেল দিল্লির কথা। এশিয়ার সব চেয়ে বড় এবং ঐতিহাসিক যৌনপল্লি কলকাতার সোনাগাছি। সেখানে প্রায় ১১ হাজার কর্মী প্রতিদিন কাজ করেন। দিনে প্রায় ২১ হাজার মানুষ সেখানে যান। সোনাগাছির যৌনকর্মীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে দুর্বার। এই এনজিও-র অন্যতম আধিকারিক মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''শুধু সোনাগাছি নয়, পশ্চিমবঙ্গের কয়েক হাজার যৌনকর্মীর পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছে। মহাশ্বেতার আশঙ্কা, ''লকডাউন উঠে গেলেও আগামী অন্তত এক মাস যৌনকর্মীরা কাজ করতে পারবেন না। করোনা সম্পূর্ণ নির্মুল না হলে তাঁদের পক্ষে কাজ করা কঠিন। একবার যদি যৌনপল্লিতে ভাইরাস ঢুকে পড়ে, সংক্রমণ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়বে। ফলে সাময়িক ত্রাণ নয়, যৌনকর্মীদের প্রয়োজন বেঁচে থাকার প্যাকেজ।'' তবে মহাশ্বেতা একই সঙ্গে জানিয়েছেন, ''পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন এবং পুলিশ শুধু সোনাগাছিতে নয়, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনপল্লিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে সাহায্য করছে রামকৃষ্ণ মিশন। যৌনকর্মীদের কাছে খাবার ছাড়াও স্যানিটাইজার এবং সাবান পৌঁছে দিচ্ছে তারা।''

সোনাগাছিতে দিনে প্রায় ২ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। স্বেচ্ছেসেবীরা সোনাগাছির যৌনকর্মীদের রোজগার অনুযায়ী কয়েকটি ভাগে ভাগ করে থাকেন। প্রথম স্তরের যৌনকর্মীরা যথেষ্ট বড়লোক। এক একজন 'বাবু'র কাছ থেকে তাঁরা মোটা অঙ্কের টাকা পান। মহাশ্বেতার কথায়, প্রথম স্তরের যৌনকর্মীদের নিয়ে ততটা ভাবনা নেই। কারণ, কিছু দিন চালিয়ে নেওয়ার মতো অর্থ তাঁদের কাছে আছে। কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরের কর্মীদের নিয়েই চিন্তা। তাঁদের পরিস্থিতি অনেকটা দিন আনি দিন খাই শ্রমিকদের মতোই। এত দিন ধরে কাজ বন্ধ হয়ে থাকায়, ভয়াবহ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছেন তাঁরা। 

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলে, দিল্লি ব্যুরো