1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শতবর্ষে বেঙ্গল প্যাক্ট: সাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালির আত্মবীক্ষণ

তায়েব মিল্লাত হোসেন
২২ ডিসেম্বর ২০২৩

ঐতিহাসিক বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তির শতবর্ষ এবার। এ সময়ে বাঙালির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কোন অবস্থায় আছে? অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে মোটাদাগে পরিস্থিতি কেমন?

https://p.dw.com/p/4aTDx
ভারত-বাংলাদেশ পতাকা
১৯২৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বাংলার মুসলিম নেতাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের জন্য চুক্তি করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। এই ‘হিন্দু-মুসলমান চুক্তি' ইতিহাসে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট' বা ‘বাংলা চুক্তি' হিসেবে পরিচিতছবি: Getty Images/G. Crouch

ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালির যে আবাসভূমি, সেখানে একদিকে পশ্চিমবঙ্গ, অন্যদিকে বাংলাদেশ। দুই বাংলার মাঝ দিয়ে চলে গেছে ২২০০ কিলোমিটারেরও বেশি সীমান্তরেখা। বাঙালিদের এই যে আলাদা মানচিত্র, ইংরেজদের বিভাজন এবং শাসন (ডিভাইড অ্যান্ড রুল) নীতি থেকেই এর সূত্রপাত। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার দোহাই দিয়ে ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ করে তারা। এর বিরোধিতায় নামে একটি পক্ষ। আর বিভাজনের পক্ষে অবস্থান নেয় অন্য গোষ্ঠী।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনই এক সময় এসে সফল হয়। ১৯১১ সালে আবার অবিভাজ্য বাংলা ফিরে আসে কলকাতার বুকে। পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে ঢাকার যে নবযাত্রা, তা ছয় বছরেই থেমে যায়। তাই বঙ্গভঙ্গের জের ধরেই বলা যায়, বাঙালি হিন্দু, আর বাঙালি মুসলমান রাজনীতিতে দু’টি পথবেছে নেয়। এতে করে বাঙালির যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহমান ছিল সমাজে, তাতেও যেন চিড় ধরে। ‘হিন্দু নেতা', ‘মুসলিম নেতা' সেজে ফায়দার রাজনীতিও হয়ে যায় সহজতর। বিশ শতকের সেই সময়ে এই সোজা পথই বেছে নেন বেশিরভাগ রাজনীতিক। বিভক্তি, বিভাজন উসকে দিতে থাকে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ।

‘বাঙালির হাতে বাঙালির রক্ত ঝরা'- এই রাজনীতি মেনে নিতে পারছিলেন না দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তার ভাবনা ছিল আরো বিস্তৃত। প্রথমত, স্বদেশবাসীর একতার মাধ্যমে ব্রিটিশ বিতাড়ন; দ্বিতীয়ত, শিক্ষা-সংস্কৃতি-অর্থনীতি-রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়া বাঙালির বড় একটি অংশকে টেনে তোলার চিন্তা।

এ প্রসঙ্গে ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন' গ্রন্থে হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘‘তিনি (চিত্তরঞ্জন) মনে করিতেন, হিন্দু-মুসলমানের সমবেত শক্তিবলে ব্যুরোক্রেসিকে আক্রমণ করিলে উহাকে পর্যদুস্ত করা যাইবে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত উভয় সম্প্রদায়ের বিদ্বেষভাব দূরীভূত না হইবে তা সম্ভব নয়।''

একতা ও সমতার মাধ্যমে বাংলার অগ্রযাত্রার বীজ বপন করতে চেয়েছিলেন স্বরাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন দাশ। এমন এক সময় একতার ধারণা নিয়ে তার কাছে যান তখনকার অন্যতম কংগ্রেস নেতা মৌলভী আবদুল করিম। এভাবেই

১৯২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর এটি স্বরাজ পার্টির অনুমোদন পায়। ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভায়ও অনুমোদিত হয় চুক্তিটি। কিন্তু কেন্দ্রীয় কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। চুক্তির বিরোধিতা করেন বাংলার অনেক কংগ্রেস নেতাও। তবু বেঙ্গল প্যাক্ট বাস্তবায়নে অটল ছিলেন চিত্তরঞ্জন। ১৯২৪ সালের জুন মাসে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে চুক্তিটির শর্তগুলো অনুসমর্থন করাতে সক্ষম হন। কিন্তু ১৯২৫ সালের জুনে দেশবন্ধুর অকালপ্রয়াণে হিন্দু-মুসলমান একতার উদ্যোগ থেমে যায়। পিছু হটে যান তার অনুসারীরাও। ১৯২৬ সালে বাংলার কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করে দেয় বেঙ্গল প্যাক্ট।

এর কারণ ব্যাখ্যা করলেন বেঙ্গল প্যাক্ট নিয়ে পিএইচডি করা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (খুলনা)-র উপপরিচালক ড. প্রদীপ কুমার মন্ডল। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, দেশবন্ধু চিত্তঞ্জন দাশের প্রয়াণের কারণে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য বড় নেতা আর বাংলায় তখন ছিলেন না। এ শূন্যতার কারণে বেঙ্গল প্যাক্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু গ্রহণযোগ্য জাতীয়তাবাদী নেতায় পরিণত হন। কিন্তু তিনিও অকালে হারিয়ে যান। তিনি যদি অন্তর্ধান থেকে ফিরে এসে বাংলার হাল ধরতেন, তবে ইতিহাস অন্যরকম হতো বলে তিনি মনে করেন।

এখন বেঙ্গল প্যাক্টের কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা জানতে চাইলে ব্রিটিশ বাংলার রাজনীতির ইতিহাস গবেষক ড. প্রদীপ কুমার মন্ডল বলেন, ‘‘বাংলাদেশ, ভারতসহ অনেক দেশেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উত্থান দেখা যাচ্ছে। এই উগ্রপন্থা দূর করতে হলে বেঙ্গল প্যাক্ট বাস্তবায়ন জরুরি।'' কারণ, সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বিষয়গুলো দূর করার কথা এতে বলা হয়েছে। বেঙ্গল প্যাক্ট বাস্তবায়ন করতে পারলে পৃথিবী থেকে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দূর হবে এবং মানবভ্যতার উন্নয়ন হবে বলে তিনি মনে করেন।

যা ছিল বেঙ্গল প্যাক্টে

 বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় বেঙ্গল প্যাক্টের শর্তগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে:

১. বঙ্গীয়-আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর মাধ্যমে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।

২. স্থানীয় পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্বের অনুপাত হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শতকরা ৬০ ভাগ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা  ৪০ ভাগ।

৩. সরকারি চাকরির শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ পদ পাবে মুসলমান সম্প্রদায় থেকে। যতদিন ঐ অনুপাতে না পৌঁছানো যায়, ততদিন মুসলমানরা পাবে শতকরা আশি ভাগ পদ এবং বাকি শতকরা কুড়ি ভাগ পাবে হিন্দুরা।

৪. কোনো সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ৭৫ শতাংশের সম্মতি ব্যতিরেকে এমন কোনো আইন বা সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা যাবে না, যা ঐ সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্বার্থের পরিপন্থি।

৫. মসজিদের সামনে বাদ্যসহকারে শোভাযাত্রা করা যাবে না।

৬. আইন সভায় খাদ্যের প্রয়োজনে গো-জবাই সংক্রান্ত কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে না এবং আইন সভার বাইরে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা আনার প্রচেষ্টা চালানো অব্যাহত থাকবে। এমনভাবে গরু জবাই করতে হবে যেন তা হিন্দুদের দৃষ্টিতে পড়ে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে। ধর্মীয় প্রয়োজনে গরু জবাইয়ের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না।

একদিকে শঙ্কা, অন্যদিকে ভোটব্যাংক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে উদ্যোগ নেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ। কেউ যেন রাজনৈতিক সুবিধার জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ব্যবহার না করে, সে বিষয়েও সতর্ক করেছে তারা।

সংখ্যালঘুদের ঘিরে এমন রাজনীতি চলে আসছে পশ্চিমবঙ্গেও। সেখানে ‘ভোটব্যাংক' মুসলমানদের সুসময় আসে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে। এমন বিবরণ দিয়ে ‘কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান' বইয়ে মিলন দত্ত লিখেছেন, ‘‘কোনো সম্প্রদায়ের গায়ে ভোটব্যাংক ছাপ লেগে যাওয়াটা যে কত বড় অপমানের, সেটা বোধ হয় তাঁরা (নেতৃবৃন্দ) ভেবে দেখেননি।''

রাজনীতির সুবিধার জন্য ধর্মের ব্যবহার, ক্ষমতার স্বার্থে ধর্মীয় বিভাজন উসকে দেওয়া- বাংলায় এর বিস্তার বিশ শতকের গোড়া থেকে শুরু। ক্ষমতা কাঠামো নিজেদের পক্ষে রাখতে সেই সময়ে এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরির নেপথ্য কারিগর ধরা হয় ইংরেজ শাসকদের। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন প্রতিহত করার কৌশলও তারা নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ইংরেজরা আসার আগে বাংলা অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বলে কিছু ছিল না। যুগ যুগ ধরে বাঙালি মিলেমিশে ছিল। অসাম্প্রদায়িকতার মধ্য দিয়ে বাংলা এগিয়ে ছিল বলেই ইউরোপের লোকেরাও এখানে বসতি স্থাপন করেছিল।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শঙ্কা নিয়ে ইতিহাসবিদ ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘এই বিষয়ে রাষ্ট্রকাঠামোকে সজাগ হতে হবে। তাদের উদ্যোগে সবাইকে নিরাপত্তাবলয়ে নিয়ে আসতে হবে।'' সুশীল সমাজের প্রভাব এখন কম, তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিতে রাজনীতিকদের বড় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান