1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিশুদের রক্ষায় চলছে যুদ্ধ

অর্ণা শীল
২৯ অক্টোবর ২০১৮

পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুদের দেহ তাদের লক্ষ্য৷ ‘পর্যটক' হয়ে আসেন৷ মানুষের অসহায়ত্ব আর লোভকে কাজে লাগিয়ে টাকার বিনিময়ে কিছুক্ষণের জন্য পেয়েও যান পছন্দের শিশুকে৷ চলছে পর্যটনের নামে এমন অমানবিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ৷

https://p.dw.com/p/37Gj0
শিশু সুরক্ষায় কর্মরত সংস্থা ‘সংলাপ’ছবি: Sanlaap

কল্পনা করুন, কোনো পাহাড়িয়া গ্রামের ‘হোম স্টে', গোয়া, পুরী বা দীঘার কোনো ‘হলিডে হোম', মহিষাদল বা ডায়ামন্ড হারবারে কোনো ‘রিসোর্ট' বা পুষ্করের কোনো হাভেলি হোটেল৷ কল্পনা করুন উৎসবের মরসুমে বা সপ্তাহান্তের ছুটিতে সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা৷ ভিনদেশী পর্যটক আছেন, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আছেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা পর্যটক৷ ও হ্যাঁ, আগে বলা হয়নি,  দেশটার নাম ভারতবর্ষ৷ চন্‌ চন্‌ করে পর্যটন শিল্পের বৃদ্ধি ঘটছে সেখানে৷ সেই বর্ধিত শিল্পের প্যাকেজে রয়েছে সস্তার টিকিট আর হোটেলের ঘর, কলের গরম জল (রানিং হট ওয়াটার), স্যাটেলাইট-টিভি আর নানান বিনোদনের আয়োজন – যার মধ্যে রয়েছে শিশুরাও, পর্যটকদের যৌন বিনোদনের রসদ হিসেবে৷ এটাই সেই পর্যটনের ‘প্যাকেজ ডিল'৷ ‘শিশুকেন্দ্রিক যৌন পর্যটন' বা চাইল্ড সেক্স ট্যুরিজমের ভারতবর্ষে আপনাকে স্বাগত৷ 

আরো আছে৷ মোবাইল ফোনে ঘুরছে চ্যাট রুম৷ হোয়াটসঅ্যাপ, স্ন্যাপচ্যাট, হ্যাংআউট, ফেসবুক, মেসেঞ্জার আরো কত কী! প্রযুক্তির ভাষায় এগুলিকে বলা হয় ‘মেসেজিং অ্যাপ'৷ এই মেসেজিং অ্যাপগুলি খবর চালাচালি করার অনিয়ন্ত্রিত পরিসর৷ সেইখানে বার্তা চালাচালি হচ্ছে৷ চালাচালি হচ্ছে ছবি৷ ভেসে উঠছে পর্ণোগ্রাফিক ওয়েবসাইটের লিংক৷ সেখানে থাকছে যৌন ক্রিয়ারত শিশুদের ছবিও৷ অনিয়ন্ত্রিত হবার ফলে নিজের সত্যিকারের পরিচয় দেবার দায় নেই এখানে৷ তাই ধরা পড়ার ভয় নেই তেমন৷ অতএব ‘শিশুকেন্দ্রিক যৌন পর্যটনে' এক বিরাট জায়গা জুড়ে অপরাধের সহযোগী ‘মোবাইল বাহন'!       

বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে শিশু-কেন্দ্রিক যৌন পর্যটন কেন?

মার্চ ২০১৮-তে হোটেলম্যানেজমেন্ট ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল ট্যুরিজম কাউন্সিল' (ডাব্লিউটিটিসি)-এর করা পর্যটনের অর্থনৈতিক প্রভাব বিষয়ক গবেষণা উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে, ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্প গত সাত বছর ধরে বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান শিল্প৷ ২০১৭-১৮-তে সারা বিশ্বে এই শিল্পের বৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ৷ তুলনায় অন্য সব শিল্পের বৃদ্ধির গড় হার ৩ শতাংশ৷ আরো দেখা যাচ্ছে যে, সারা পৃথিবীতে ৫ জন মানুষের মধ্যে ১ জনের গ্রাসাচ্ছাদন জোগাচ্ছে এই শিল্প৷ বিশেষত ২০১৭ সালে দেখা গেছে যে, মুনাফা বাড়ানোর প্রত্যাশায় এই শিল্পে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় স্তরে ঘটে চলেছে এই বৃদ্ধি৷ দক্ষিণ এশিয়া ও ভারতবর্ষেও এই বৃদ্ধি দৃশ্যমান৷ আর এই আশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যেই প্রদীপের নীচে ঘনাচ্ছে অন্ধকার, হু-হু করে বাড়ছে শিশুকেন্দ্রিক যৌন পর্যটন৷

ইউকেএসেজ ডটকম-এ ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ইদানীংকালে যৌন পর্যটনের ক্ষেত্রে পর্যটকদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বদলে শিশুদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে৷ অতএব শিশুকেন্দ্রিক যৌন পর্যটনে তিন ধরনের যৌন-শোষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে৷ যথাক্রমে সেগুলি হচ্ছে: ১. পতিতাবৃত্তি ২. পর্নোগ্রাফি এবং ৩. যৌনকাজে ব্যবহারের জন্য পাচার৷

‘সংলাপ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা'র ২০০৩ সালের গবেষণার রিপোর্ট জানাচ্ছে, শিশুকেন্দ্রিক যৌন পর্যটন মুনাফা বাড়ানোর খুব সহজ একটি উপায়৷ এই কাজে যে শিশুদের পাচার করে, ভুলিয়ে, ভয় দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসে আর্থসামাজিকভাবে দুর্বল বা সংবিগ্ন পরিবার থেকে৷ এদের আনতে ‘বিনিয়োগ' লাগে অল্পই৷ ঋণদায়গ্রস্ত মা-বাবার বিক্রি করে দেওয়া, বাড়িতে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যাওয়া, ভালোবাসার খোঁজে ভুলিয়ে আনা এইসব শিশুকে এই ‘কাজে' নিয়োগ করাও সহজ, কারণ, তাদের কোনো রক্ষাকবচ নেই; কারণ, তাদের ধরার জন্য দেশজুড়ে পাতা আছে বিরাট এক দালাল চক্রের জাল৷ তাদের মুখে অনেক মুখোশ – অভিভাবকের, আত্মীয়ের, প্রতিবেশীর, প্রেমিকের৷ বিশ্বাস আর ভরসার প্রতীক এইসব মুখোশের আড়ালে তাই তাদের সহজে চেনা যায় না৷ তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে হারিয়ে যেতেই পারে কোটি কোটি শিশু৷ একবার ঘরছাড়া হয়ে গেলে, যৌন পর্যটনের ক্ষেত্রে, অটো চালক থেকে শুরু করে দোকানদার, হোটেলের মালিকপক্ষের লোকজন, সবাই শিশুদেরকে অর্থের বিনিময়ে ‘খরিদ্দার' অবধি পৌঁছানোর কাজে যুক্ত থাকতে পারে৷ সস্তার হোটেল থেকে সাত তারা বুটিক হোটেলে, ২৫ টাকা মূল্য থেকে লক্ষ টাকা মূল্যে নিয়মিত যৌন কাজকর্মে লিপ্ত হতে হচ্ছে শিশুদের৷ সে টাকা অবশ্যই পাচ্ছে না তারা৷ পাচ্ছে তাদের ‘এজেন্ট'৷ যেহেতু ভার্জিন বা কুমারীদের সঙ্গে যৌন সংসর্গের চাহিদা খুব বেশি, এইসব শিশুকে ‘পাওয়ার' জন্য অনেক বেশি মূল্য দিতে রাজি যৌন পর্যটকেরা৷ তাহলে বোঝা গেল যে, অতি অল্প মূল্যে (টাকা বা জিনিসের বিনিময়ে) কেনা শিশুকে অতি চড়া দামে যৌন সংসর্গের জন্য ‘কিনতে' রাজি হয় যৌন পর্যটকেরা৷

সংলাপের রিপোর্টে ভারতের জাতীয় হিউম্যান রাইটস কমিশনের শীর্ষ অধিকর্তা এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার মন্তব্য করেছেন যে, দুনিয়া জুড়ে অস্ত্রভিত্তিক বাণিজ্যের থেকেও বেশি লাভ করা যায় যৌনতার ব্যবসায়৷ সুতরাং শিশুদের যৌনতাকে পণ্যায়ন করাটাও যে পর্যটন শিল্পে মুনাফা বর্ধন করার একটা পন্থা হয়ে উঠবে, এই ভোগবাদসর্বস্ব দিনকালে এতে আর অবাক হবার কী আছে! আর এটাও পরিষ্কার যে, প্রতিরোধ তৈরি না হলে, পর্যটন শিল্পে যত ‘উন্নতি' হবে, ভারতে তথা সারা বিশ্বেও শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে ততটাই৷

Dr. Arna Seal
অর্ণা শীল, পশ্চিমবঙ্গের সমাজকর্মী ও গীতিকারছবি: Privat

কোথায় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র ও আইন?

ভারতে ২০১২ সালে ‘প্রটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেনসেস অ্যাক্ট' বা পকসো আইন প্রণীত হয়৷ এই আইনের মাধ্যমে এখন আরো বেশি করে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগ এনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়৷ সংলাপ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার একজন মুখ্য কর্ণধার তপতী ভৌমিকের মতে, ‘‘এই আইন প্রণয়ন হবার পর থেকে অনেক অপরাধীকেই এর আওতায় এনে শাস্তির আইনি দাবি তোলা যাচ্ছে৷ নালিশ নথিভুক্ত করার প্রবণতাও বেড়েছে, যদিও এই আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরো অনেক বেশি সচেতনতা দরকার, তাদের আরো তথ্য দেওয়া দরকার৷ তবে শুধু আইন প্রণয়ন করে কিছুই হবে না, সবথেকে আগে দরকার মানসিকতার পরিবর্তন৷'' 

এক অর্থে তাই এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের বক্তব্যেও এক ধরনের অসহায়তা ধরা পড়ে৷ ২০১৬ সালে দিল্লিতে শিশু নির্যাতন নিয়ে একটি সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন, ‘‘শিশুদের সামনে বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে একযোগে শিশু পর্নোগ্রাফি ও সেক্স ট্যুরিজ্ম৷ ...হাতের মুঠোয় চলে আসা তথ্যপ্রযুক্তি ও বিশ্ব অর্থনীতির বদলে যাওয়া চরিত্র, সেক্স ট্যুরিজম বা যৌন পর্যটন, শিশু পর্নোগ্রাফি ও অনলাইন হুমকির মতন বিপদের সম্মুখীন করেছে শিশুদের৷ আমরা উপলব্ধি করছি যে, শিশুদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করতে পারছি না৷'' 

...তাই যুদ্ধ চলছে

সংলাপের তপতী ভৌমিক বা দেশজুড়ে তাঁর মতন অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা গত কয়েক বছর ধরে ছুটছেন – দার্জিলিং থেকে গোয়া, মুম্বই থেকে আলেপ্পি, পুষ্কর থেকে চেন্নাই – হোটেল, হোম-স্টে, অটো, বাস, মন্দির, ট্র্যাভেলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের কাছে৷ দেয়ালে দেয়ালে সাঁটা হচ্ছে পোস্টার৷ শিশু যৌন পর্যটনের বিষয়টি (যা কিনা এতদিন একটি উপেক্ষিত বিষয় ছিল) উঠে আসছে মন্ত্রী এবং আধিকারিকদের আলোচনায়৷ পশ্চিমবঙ্গে সংলাপের একটি প্রকল্পে কিশোর-কিশোরীরা সামাজিক মানচিত্র তৈরি করে জনপ্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরছে তাদের বিপন্নতা৷ আধিকারিকদের শিশু-সুরক্ষা বিষয়ে আরো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে তারা৷ মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা৷

তপতীর মতে, ‘‘দু-তিন বছর ধরে ‘বোঝানোর' পর কোনো কোনো জেলায় এসোসিয়েশনগুলি শিশুকেন্দ্রিক যৌন পর্যটন নিষিদ্ধ করা বা সে ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ কেউ কেউ এখনো রাজি নন৷ তাই যুদ্ধ চলছে!'' ঠিক তাই–যুদ্ধ চলছে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য