1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সন্দেশখালির পর ভূপতিনগর : তদন্তকারীর ওপর হামলা চলছেই

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১১ এপ্রিল ২০২৪

ইডির পর এনআইএ। তদন্তে গিয়ে আবার আক্রান্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা। হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করবে কী, তদন্তকারীদের বিরুদ্ধেই তোলা হলো শ্লীলতাহানির অভিযোগ, সেই অভিযোগ তদন্তেই নেমে পড়লো পুলিশ৷

https://p.dw.com/p/4ee8f
ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির নয়াদিল্লির প্রধান কার্যালয়
২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগরে তৃণমূলের বুথ সভাপতির বাড়িতে প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরণ হয়৷ বিস্ফোরণে প্রাণ হারান তিনজন৷ আদালতের নির্দেশে সেই ঘটনার তদন্ত করছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ।ছবি: Hindustan Times/IMAGO

২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগরে তৃণমূলের বুথ সভাপতির বাড়িতে প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরণ হয়৷

বিস্ফোরণে প্রাণ হারান তিনজন৷ আদালতের নির্দেশে সেই ঘটনার তদন্ত করছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ।

আধিকারিক জখম

শনিবার ভূপতিনগরের নারুয়াবিলা গ্রামে বিস্ফোরণ মামলার তদন্তে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকরা। ভোর পাঁচটা নাগাদ অভিযুক্তদের বাড়ি গিয়েছিলেন তারা। বিস্ফোরণকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে দুই তৃণমূল কর্মীকে আটক করে নিয়ে আসার সময় আধিকারিকদের ঘিরে ধরা হয়।  গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এক আধিকারিক আহত হন।

এই ঘটনায় ভূপতিনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করে এনআইএ। তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেন তৃণমূল কংগ্রেসের ধৃত বুথ সভাপতির স্ত্রী। এনআইএ কর্মকতাদের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। এমনকি সংস্থার সঙ্গে যাওয়া আধাসেনা জওয়ানরা অলংকার চুরি করেছেন - এমন অভিযোগও করা হয়৷

ভূপতিনগর থানা তদন্ত শুরু করেছে। এনআইএ ও তৃণমূল নেতার স্ত্রীর করা মামলার ক্ষেত্রে তদন্তকারী আধিকারিকদের বদলে দিয়েছে জেলা পুলিশ। তদন্তকারীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলেছেন। অভিযোগকারিনীর বয়ান রেকর্ড করেছেন। অভিযান চালানো আধিকারিকদের থানায় ডেকে পাঠানো হয়।

তবে এনআইএ আধিকারিকদের হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে এখনো পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। প্রশ্ন উঠেছে, সেদিন যারা কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তকারীদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখালেন, তাদের ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও কেন কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি?

তৃণমূল নেতা বা কর্মী সমর্থকরা অভিযুক্ত বলেই পুলিশ তাদের ধরছে না, এমনটাই দাবি বিরোধী এবং বিশ্লেষকদের।

হামলার পর এক নির্বাচনি জনসভায় তৃণমূল সুপ্রিমো, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, এনআইএ কর্মকর্তারা পুলিশকে না জানিয়ে ভূপতিনগরে গিয়েছিলেন৷ সেখানে গিয়ে কর্মকর্তারা ধৃত দুই তৃণমূল নেতা-কর্মীর পরিবারের ওপর নির্যাতন চালান বলেও দাবি করেন মমতা৷ তবে সাবেক পুলিশ কর্তা পঙ্কজ দত্ত সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, "এনআইএ কবে, কোথায় যাবে, এটা কোনো রাজ্যের প্রশাসনকে জানাতে বাধ্য নয়। কিন্তু তারা আক্রান্ত হলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার, সেটা এই রাজ্যে দেখা যাচ্ছে না।"

ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে। গত ৫ জানুয়ারি তৃণমূলের দাপুটে নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে অভিযানে গিয়ে আক্রান্ত হয় ইডি। এরপর কেন্দ্রীয় সংস্থা আধিকারিকদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করা হয় স্থানীয় থানায়। সেই মামলা এখনো চলছে।

বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "এরকম হলে কোনো তদন্ত ঠিকভাবে এগোবে না। তদন্ত করতে গেলে যদি শ্লীলতাহানির মামলা দেয়া হয়, সেটা অনেকদিন ধরে চলবে। এই পরিস্থিতিতে আধিকারিকরা চাইবেন, কোনোভাবে কাজ সেরে চলে যেতে। এখানে কাজ করতে তারা আগ্রহ পাবেন না। এতে তদন্ত ব্যাহত হবে।"

তার বক্তব্য, "ইডি, এনআইএ তৈরি হওয়ার সময় দিল্লির ইউপিএ সরকারের শরিক ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের সমর্থনে এই সংস্থাগুলির গঠন সংক্রান্ত আইন সংসদে পাশ হয়েছে। এখন তারা এর বিরোধিতা করছে।"

কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, ঝাড়খণ্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। এই দুই জায়গায় পশ্চিমবঙ্গের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এ রাজ্যের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল সহ অনেক নেতা ধরা পড়েছেন। তখন এই জাতীয় সংঘাত না হলেও চলতি বছর থেকে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে প্রতিরোধের নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

মমতার তোপ

মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। তার দাবি, এনআইএ রাতে অভিযান চালিয়ে নারী নিগ্রহ করেছে। পরে পুলিশকে জানিয়েছে তাদের আসার খবর। ভূপতিনগরে বিস্ফোরণকে 'চকোলেট বোমা' ফাটার সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি।

যদিও ২০২২ এর ওই বিস্ফোরণ বেশ জোরালো ছিল বলে স্থানীয়দের দাবি। তৃণমূলের তৎকালীন বুথ সভাপতি রাজকুমার মান্নার বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়। এর জেরে বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়। আট কিলোমিটার দূর থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল। রাজকুমার সহ তিনজন এই বিস্ফোরণে মারা যান।

এই মামলায় এনআইএ এখনো পর্যন্ত দুই তৃণমূল নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। রাজকুমারের উত্তরসূরী, এখনকার বুথ সভাপতি ছাড়াও অঞ্চল সভাপতি বলাই মাইতিকে পাকড়াও করা হয়েছে।

এছাড়া আরো তিন তৃণমূল নেতাকে তলব করেছে তদন্তকারী সংস্থা। মেদিনীপুরের জেলা পরিষদের সদস্য মানব পড়ুয়া, শাসক দলের নেতা নবকুমার পন্ডা ও সুবীর মাইতিকে একাধিকবার তলব করা সত্ত্বেও এনআইএ দপ্তরে তারা হাজিরা দেননি।

বুঝে গিয়েছে, অপরাধ করলেও ধরবে না: রবীন্দ্রনাথ

তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ দাবি করেছেন, "বিজেপির পরামর্শে ইডি, সিবিআইয়ের মতোই কাজ করছে এনআইএ।" তারা ভিডিও ফুটেজ সামনে এনে অভিযোগ করেছেন, "বিজেপি নেতা জিতেন্দ্র তিওয়ারি তদন্তকারী সংস্থার এসপি পদমর্যাদার আধিকারিক ধনরাম সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।"

এনআইএ কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। ওই আধিকারিককে নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় তাকে দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয়েছে। ধনরামের বদলে পশ্চিমবঙ্গে পাঠানো হচ্ছে অন্য এক আধিকারিক রাকেশ রোশনকে।

তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে কেন্দ্রের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি চিঠি লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে।

অভিষেকের অভিযোগ, ইডি, সিবিআই, এনআইএর মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে দিল্লির সরকার। নির্বাচনের মুখে বিরোধীদের দুর্বল করতে এই কৌশল নেয়া হয়েছে।

দিল্লিতেও উত্তাপ

দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের ফুল বেঞ্চের সামনে একই অভিযোগ রেখেছে তৃণমূলের প্রতিনিধি দল। তারা গতকাল কমিশন কার্যালয়ের সামনে ২৪ ঘন্টার জন্য বিক্ষোভেও বসে যায়। পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে গেলে ধুন্ধুমার বাধে। এরপর থানার সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করেন তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা।

পর্যবেক্ষকদের মতে, কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল যেভাবে যুযুধান, সেই ভাবেই যেন দুই সরকারের একাধিক সংস্থা একে অপরের বিরুদ্ধে তৎপর! সন্দেশখালির পর ভূপতিনগরের ক্ষেত্রেও একই ছবি দেখা গেল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে, "বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণকে বলা হয়েছিল গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে হয়েছে। পরে দেখা গেল, বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন যুক্ত রয়েছে এর সঙ্গে। ভূপতিনগরের ক্ষেত্রেও যে কোনো জঙ্গি সংগঠনের যোগ নেই, এটা কে বলতে পারে? জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে বলেই এনআইএ তদন্ত করছে আদালতের নির্দেশে। সেই তদন্তে অসহযোগিতা বা আধিকারিকদের আক্রমণ করা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।"

নির্বাচনের মুখে কেন্দ্রীয় সংস্থার তৎপরতা যে বিরোধীদের বেকায়দায় ফেলার জন্যই, সে ব্যাপারে একমত পর্যবেক্ষকদের বড় অংশ। তবে তদন্তকারীদের উপর হামলা ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পদক্ষেপকে তারা সমর্থন করছেন না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে বলে এখানে তদন্তকারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে এতে প্রশ্রয় রয়েছে। দুষ্কৃতীরা বুঝে গিয়েছে, তারা অপরাধ করলেও তাদের কেউ ধরবে না।"

রাজনৈতিক স্বার্থে সিবিআই, ইডির ব্যবহার হোক কিংবা তার মোকাবিলায় পুলিশকে কাজে লাগানো, সবটাই ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, "দুষ্কৃতীরা যদি আইন হাতে তুলে নেয়, তা হলে আগামী নির্বাচন সহিংস হয়ে উঠবে। অতীতে আমরা অনেক হানাহানি দেখেছি। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক নয়।"

ফেব্রুয়ারি মাসের ছবিঘরটি দেখুন:

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান