1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সুতানুটি থেকে কলকাতা

২০ মার্চ ২০১৮

গত কয়েক দশকে আধুনিকতার নিরিখে অনেকটাই এগোতে পেরেছে ভারতের বেশ কিছু শহর৷ যানবাহন থেকে রাস্তাঘাট, উন্নতি হয়েছে অনেক কিছুরই৷ কিন্তু এখনো অনেক পথ চলার বাকি৷

https://p.dw.com/p/2uVe5
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar

সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা৷ তিনটে গ্রামকে এক করে প্রথম কলকাতা মহানগরী তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন ব্রিটিশরা৷ কলকাতা শহরের প্রথম নগর পরিকল্পনাও তাদের হাতেই৷ মজা হলো, স্বনামধন্য ব্রিটিশ স্থপতিরা একটা প্রাথমিক গলদ করে ফেলেছিলেন৷ তাঁরা দেখেছিলেন, শহর কলকাতায় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের যা পরিমাণ, লন্ডনেরও তাই৷ লন্ডনের পয়ঃপ্রণালী সে সময় যুক্ত ছিল টেমসের সঙ্গে৷ সেই আদলে তারাও গঙ্গার উপর ভরসা রেখে কলকাতায় প্রথম পয়ঃপ্রণালীর বন্দোবস্ত করলেন৷ আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন তৈরি হলো৷ কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সমস্যা স্পষ্ট হলো৷ লন্ডনে সারা বছর যে বৃষ্টি হয়, কলকাতায় তা হয় মাত্র কয়েকমাসে৷ ফলে সেই বিপুল পরিমাণ জল মাটির তলার পয়ঃপ্রণালী ধরে রাখতে পারে না৷ উপচে ওঠে৷ গঙ্গাও ফুলে ফেঁপে ওঠে বৃষ্টির মরশুমে৷ শুরু হলো বাৎসরিক বন্যা৷ সেই সমস্যা এখনো কলকাতা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷ তবে ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে কলকাতার পয়ঃপ্রণালী অনেকটাই সংস্কার করা হয়েছে৷ ব্রিটিশদের তৈরি সেই ব্যবস্থার কাঠামো অপরিবর্তিত রাখলেও জল নিকাশির আরো নানা পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে৷ ফলে আগের চেয়ে বন্যা হয় কম৷

বন্যার সঙ্গে তো না হয় মোলাকাত করা গেল৷ কিন্তু বাকি ক্ষেত্রে? নগর পরিকল্পনায় নানাবিধ সমস্যা ছিল কলকাতার৷ শুধু কলকাতারই বা কেন? ব্রিটিশ আমলে তৈরি ভারতের বড় বড় শহরগুলি একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে৷ যার অন্যতম, লোকসংখ্যা৷ একটা সময় ছিল, গ্রামগঞ্জের যে সমস্ত মানুষেরা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁরা জীবিকার খোঁজে চলে আসতেন পার্শ্ববর্তী বড় শহরগুলিতে৷ শুধু আসতেন না, থেকেও যেতেন শহরে৷ যে কারণে গত ৭০ বছরে প্রতিটি শহরই আকারে আয়তনে অনেক বড় হয়েছে৷ শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শহরতলি৷ কলকাতার ক্ষেত্রে সমস্যা আরো জটিল হয়েছিল দেশভাগের পর৷ '৪৮ থেকে '৭১ সালের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ওপার বাংলা থেকে শরণার্থী হয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন এপার বাংলায়৷ অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে৷ ফলে দ্রুত কলকাতার জনসংখ্যা চোখে পড়ার মতো বেড়ে যায়৷ শহরের উপান্তে কলোনি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করেন তাঁরা৷ স্বভাবতই সে সমস্ত কলোনিতে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না৷ যে যার মতো মাথার উপর আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে নেন৷ কয়েকদশক পর সেই সামান্য ছাউনি বাড়ির আকার নিতে শুরু করে৷ গায়ে গায়ে লাগানো অপরিকল্পিত বাড়ি, সরু রাস্তা, পয়ঃপ্রণালীর বেহাল অবস্থা, এই সমস্ত সমস্যাই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে৷ তার সঙ্গে গাড়ির চাপ আর কাজের খোঁজে আসা মানুষের চাপ৷

আশি-নব্বইয়ের দশকে বিশেষত কলকাতা এবং দেশের অন্যান্য শহরগুলি সময় সময় কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়ত৷ রাস্তায় গাড়ি নড়ত না৷ বাসে-ট্রামে ‘বাঁদুর ঝোলা' হয়ে যাতায়াত করতে হতো নিত্যযাত্রীদের৷ তার ওপর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই! অবস্থা আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠত৷

নব্বইয়ের শেষ এবং একুশ শতকের গোড়ায় গোটা দেশেই নতুন পরিকল্পনা তৈরি করার প্রবল প্রয়োজন বোধ হয়৷ পূর্বে এবং পশ্চিমে আধুনিক নগর স্থপতিরা মনে করেন, পুরনো শহরকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে নগরের বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন৷ শহর লাগোয়া বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে তুলতে হবে আরো অনেক উপনগরী৷ যাতে বড় শহরের ওপর চাপ কমে৷ মানুষ আরো নতুন নতুন কাজের জায়গা খুঁজে পান৷ তার সঙ্গে প্রয়োজন রাস্তা এবং যানবাহনের উন্নতি৷

পশ্চিমবঙ্গে এই পরিকল্পনা আরো খানিক আগেই শুরু হয়েছিল৷ স্টিল প্লান্টকে কেন্দ্র করে দুর্গাপুর এবং আসানসোলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ উপনগরী তৈরির চেষ্টা হয়েছিল সেই স্বাধীনতা পর্বেই৷ অন্যদিকে উত্তরে শিলিগুড়িকে গুরুত্বপূর্ণ শহর তৈরির চেষ্টা হয়েছিল৷ সঙ্গে শহরের ভিতর মেট্রো তৈরির পরিকল্পনা হয়েছিল৷ ভারতের মধ্যে কলকাতাই প্রথম মেট্রো তৈরি করে মাটির তলায়৷ কিন্তু সমস্যা হলো, উপনগরী তৈরি করতে হলে তার জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়৷ নতুন নতুন কলকারখানা তৈরি করতে হয়৷ পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ ইতিহাসে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়েছে৷ একসময় গঙ্গার অন্যপ্রান্তে কলকাতার উলটো দিকে হাওড়া, কারখানা শহর হিসেবে জনপ্রিয় ছিল৷ বলা হতো হাওড়া হলো প্রাচ্যের ম্যাঞ্চেস্টার৷ কিন্তু ব্রিটিশ পরবর্তী কলকাতায় একের পর এক কারখানা বন্ধ হতে থাকে৷ নতুন কারখানাও গড়ে উঠছিল না৷ ফলে একদিকে দুর্গাপুর-আসানসোল আর অন্যদিকে কল্যাণী ছাড়া সেভাবে কোনো উপনগরী তৈরি করে উঠতে পারেনি কলকাতা৷ শিলিগুড়ি অবশ্য ক্রমশ নিজের জায়গা তৈরি করে নিচ্ছিল ব্যবসার শহর হিসেবে৷

নগর পরিকল্পনা নিয়ে কলকাতা যখন ধুঁকছে, ভারতের অন্য শহরগুলিতে তখন একের পর এক উপনগরী তৈরি হচ্ছে৷ যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ দিল্লি৷ রাজধানী শহর বাড়তে বাড়তে একদিকে হরিয়ানা অন্যদিকে উত্তরপ্রদশে ঢুকে পড়ে৷ আলাদা আলাদা কাজের জন্য আলাদা আলাদা ‘হাব' তৈরি করে ফেলে দিল্লি৷ ফলে একসময় যে দিল্লিতে কয়েক কিলোমিটার যাতায়াত করতে কয়েকঘণ্টা লেগে যেত জ্যামজটের কারণে, নিমেষের মধ্যে তা বদলে যায়৷ বিকেন্দ্রীকরণের ফলে মানুষও ছড়িয়ে যান শহরতলিতে৷ দিল্লি অধিবাসীরা এখন অনেকেই বলেন, হরিয়ানায় পেট্রোল ভরে তাঁরা উত্তরপ্রদেশে কাজ করতে যান৷

মুম্বইয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল৷ নবি মুম্বই যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ৷ পাশাপাশি শহরের ভিতরের ট্রেন চলাচলেও গুরুত্ব দেয় মুম্বই৷ এখনো সেখানে অধিকাংশ মানুষ শহরতলি থেকে ট্রেনে চড়ে শহরে আসেন, কাজ করেন আবার শহরতলিতে ফিরে যান৷ কিন্তু ভৌগোলিক কারণেই মুম্বই নবি মুম্বই ছাড়া খুব বেশি হাব তৈরি করতে পারেনি৷ কাজের জন্য লোকজনকে শহরতলি থেকে এখনো শহরে প্রবেশ করতে হয়৷ ফলে অফিস টাইমে মুম্বইয়ে জ্যামজট এখনো অব্যাহত৷

প্রথামকি ভাবে মুখ থুবড়ে পড়লেও, ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে কলকাতাও নিজেকে বড় করতে শুরু করে৷ শহরের পূর্বপ্রান্তে গড়ে তোলা হয় আইটি হাব৷এখন যা নিউ টাউন বলে পরিচিত৷ পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা হয় আস্ত একটা উপনগরী৷ নিউ টাউনে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অনেকেই এখন নিউ টাউনেই থাকেন৷ মূল কলকাতায় তাঁদের আসতেই হয় না৷ যদিও প্রয়োজনে শহরে আসতে তাঁদের সময় লাগে এক থেকে একঘণ্টা৷ শহরের নতুন নগর স্থপতিরা চাইছেন, নিউ টাউনের মডেলে শহরতলিতে আরও নতুন নতুন হাব তৈরি করতে৷ শহরের দক্ষিণে বারুইপুর থেকে উত্তরে বারাসত পর্যন্ত ছোট ছোট হাব তৈরির প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে৷ কিন্তু সমালোচকদের বক্তব্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হলে কোনো হাবই ফলপ্রসূ হবে না৷

অন্যদিকে শহরের ভিতর জ্যামজট কমানোর জন্য উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত মেট্রো খুবই সাফল্য পেয়েছে৷ নতুন করে পূর্ব থেকে পশ্চিম এবং দক্ষিণ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত মেট্রোর লাইন তৈরির কাজও অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে৷ আগামী কয়েকবছরের মধ্যে যা সম্পূর্ণ হলে উত্তরের শহরতলি থেকে দক্ষিণের শহরতলিতে পৌঁছনো যাবে এক দেড়ঘণ্টার মধ্যে৷

Syamantak Ghosh
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

ফ্লাইওভার আর মেট্রো কলকাতার গতি বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে৷ ভারতের অন্যান্য বড় শহরেও মেট্রো খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে৷ ফ্লাইওভার চোকে পড়ার মতো গতি বাড়িয়েছে শহরের৷ কিন্তু কেবল নতুন জিনিস তৈরি করলেই তো হবে না! নগর পরিকল্পনার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল পুরনোকে বাঁচিয়ে রাখা৷ পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখা৷ এই বিষয়টি নিয়েই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে৷ আধুনিকতার নামে একের পর এক ভেঙে ফেলা হচ্ছে পুরনো বাড়ি৷ শতাব্দীপ্রাচীন ভেঙে ফেলে ফ্ল্যাট তৈরি করা হচ্ছে৷ আধুনিক নগর পরিকল্পকেরা ঠিক এখানেই ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের তুলনা টানতে শুরু করেছেন৷ প্রাগ৷ চেক রিপাবলিকের এই রাজধানী শহরটি ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পুরনো শহরে ছোটছোট হেরিটেজ জোন তৈরি করেছে৷ অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট বাড়ি বা বাজার বা অফিস কেবল হেরিটেজ নয়৷ গোটা অঞ্চলটাই হেরিটেজ৷ প্রতিটি হেরিটেজ জোনের নির্দিষ্ট নিয়ম আছে৷ ইচ্ছে মতো সংস্কার কাজ চালানো যায় না সেখানে৷ বিশেষ কমিটির কথা মেনে বাড়ি ঘর রাস্তার সংস্কার করতে হয়৷ পুরনো কলকাতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ঠিক একইভাবে হেরিটেজ জোন তৈরি করা দরকার৷ নইলে শহর হয়ত আধুনিক হবে কিন্তু ইতিহাসের ধুলোয় পরিণত হবে প্রাচীন ইতিহাস৷ বিশিষ্ট লেখক অমিত চৌধুরী এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা৷ তাঁদের বক্তব্য কলকাতার ইতিহাস বাঁচানোর জন্য কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে না সরকার৷ বস্তুত কলকাতার সেই আন্দোলনের মডেলে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে চেন্নাই এবং হায়দরাবাদেও৷

একদিকে ঐতিহ্য, অন্যদিকে আধুনিকীকরণ৷ সবকিছু একসঙ্গে রক্ষা করা কঠিন৷ তবে অনেকেই বলছেন, গত এক দশকে দু'য়ের মিশেলে ভারতে বেশ কয়েকটি শহর চোখে পড়ার মতো উন্নতি করেছে৷ তবে এখনো পথ অতিক্রান্ত করতে হবে অনেক৷ যার জন্য প্রয়োজন সরকার, প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের সৎ প্রচেষ্টা এবং শহরের প্রতি ভালোবাসা৷ সেখানেই বোধহয় ঘাটতি থেকে যায় সবচেয়ে বেশি৷

কেমন লাগলো ব্লগটি, লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷