1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সৌদি আরবের কাছে কেন জবাব চায় না সরকার?

ফয়সাল শোভন
২৯ নভেম্বর ২০১৯

সৌদি আরব থেকে একের পর এক ফিরছে নারী শ্রমিকের লাশ৷ অনেকে ফিরেছেন নির্যাতনের ভয়াবহ চিহ্ন আর স্মৃতি নিয়ে৷ একটি দেশের নাগরিক অন্য দেশে গিয়ে এমন নিগ্রহের শিকার হওয়ার পরও কেন চুপ বাংলাদেশ সরকার?

https://p.dw.com/p/3TxDx
ফাইল ফটোছবি: Imago Images/Zuma/M. Hasan

দীর্ঘ সাত বছর বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ রাখার পর ২০১৫ সালে সৌদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা শুরু হয়৷ শেষদিকে এসে হয় চুক্তি৷ শর্ত ছিল বাংলাদেশ আগে গৃহকর্মীসহ বিভিন্ন নারী শ্রমিক পাঠাবে, তবেই পুরুষদের জন্য দেশটির শ্রমবাজার উন্মুক্ত হবে৷ চুক্তির আগে-পরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো এই বিষয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলন করে খবরাখবর জানিয়েছে৷ সেই সময়ের মন্ত্রী আর সচিবকে গণমাধ্যমকর্মীরা বারবার নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন৷ মন্ত্রণালয় থেকে সব ধরনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল৷ কথা ছিল মোবাইলে সার্বক্ষণিক নারীদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকবে, দূতাবাস প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ নেবে ইত্যাদি৷ 

আসলে কতটা নিরাপত্তা তারা নিশ্চিত করেছেন তার নমুনাটা দেখা যাক৷ গত চার বছরে সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন আট হাজার নারী শ্রমিক৷ বলা বাহুল্য, তাদের অধিকাংশ ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন৷ এক বুক স্বপ্ন নিয়ে যারা দেশ ছেড়েছিলেন, তারা  বয়ে এনেছেন ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন আর মানসিক যাতনার স্মৃতি৷ ৬৬ জন ‘ভাগ্যবান' ফিরেছেন লাশ হয়ে৷ অথচ এই মানুষগুলো প্রত্যেকেই গিয়েছিলেন উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্ন তাদেরকে সরকার বা রাষ্ট্রই দেখিয়েছে৷ দায়টা তাই তাদের মাথা পেতে নেয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু নিজের জনগণ অন্য দেশে গিয়ে নিগৃহীত হচ্ছেন, সেজন্য সামান্য বিব্রতও কি সরকার হয়েছে?

তাদের কাছে অবশ্য হত্যা বা নির্যাতনের চিত্রটা নিছক কিছু সংখ্যা৷ সেখানে রক্ত মাংসের শরীরের মানুষ নেই৷ তাদের কান্না, তাদের উপর নির্ভরশীল পরিবারের কোনো অস্তিত্ব নেই৷ সেকারণেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবলীলায় বলতে পারেন, ‘‘শতকরা হিসেবে সংখ্যাটা খুবই সামান্য৷ ৯৯ শতাংশ নারী ‘ম্যানেজ' করে নিয়েছেন৷'' একটি দেশের নাগরিক যখন অন্য দেশে যান, তাও আবার পাচার নয়, অবৈধভাবে নয়, দুই সরকারের মধ্যে করা চুক্তির অধীনে, তখন তার সমস্ত ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব সরকারের; বিশেষ করে সামনে থেকে ভূমিকাটি রাখার কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের৷ কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী যখন এমন কথা বলেন তখন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটি বুঝতে আর বাকি থাকে না৷কিন্তু সমস্যাটা কি শুধু দৃষ্টিভঙ্গিতে, নাকি সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের নতজানু কূটনৈতিক সম্পর্কও এর জন্য দায়ী?

একের পর এক নারী নির্যাতিত ও লাশ হয়ে ফেরার ঘটনায় সৌদি সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ, ব্যবস্থা নেয়ার দাবি কিংবা অন্ততপক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ব্যাখ্যা চাইতে পারতো সরকার৷ সেটা স্বাভাবিক কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ারই অংশ হতে পারতো৷ কিন্তু এমন কিছু ঘটেছে বলে আমরা শুনতে পাইনি৷ গত তিন বছরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার রাষ্ট্রীয় সফরে গেছেন দেশটিতে৷ সেখানে একটিবারের জন্য তিনি দেশটির বাদশাহ বা রাজপরিবারের কাছে কি এই প্রসঙ্গ তুলেছেন? যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যে গেলে প্রধানমন্ত্রী সেখানকার বাংলাদেশিদের সাথে দেখা করেন৷ সৌদি আরবের প্রবাসী শ্রমিকরা, তার দেশের নারী গৃহকর্মীরা বাড়ির অন্দরমহলে কেমন আছেন, তিনি কি কখনো তাদের কাছ থেকে জানার উদ্যোগ নিয়েছেন? এমন কোনো খবর আমরা পাইনি৷

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের প্রতিবাদ তো দূরে থাক, উল্টো সৌদি সরকারই হুমকি দিয়েছে সরকারকে৷ প্রথম আলোতে ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীদের নির্যাতনের অভিযোগ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় নাকি বিব্রত হয়েছে দেশটি৷ আর বাংলাদেশকেই সেগুলো সুষ্ঠুভাবে সমাধান করতে বলেছে তারা৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘তা না হলে নারী গৃহকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সৌদি কর্তৃপক্ষ একতরফাভাবে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে বলে বাংলাদেশকে বলে দিয়েছে৷'' চিন্তা করে দেখুন, যা ঘটছে তাতে ঠিক এই কথাগুলো বাংলাদেশের বলার কথা সৌদি আরবকে৷ কিন্তু দেশটি উল্টো বাংলাদেশকে ধমকাচ্ছে৷ আবার বাংলাদেশের যেখানে কড়া প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শতকরা হিসাবের অঙ্ক কষে ‘তেমন কিছুই ঘটছে না' মর্মে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন৷ কেন এত ভয় আর অনীহা সৌদি আরবের কাছে প্রতিবাদ জানাতে? 

DW-Mitarbeiter Porträt Faisal Ahmed
ফয়সাল শোভন, ডয়চে ভেলেছবি: Masum Billah

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সৌদি আরব ছিল পাকিস্তানের পক্ষে৷ স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম এই শক্তি৷ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় দুই দেশের মধ্যে৷ এরপর একে একে ৪০ লাখ শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরবে৷ সেখান থেকে তারা বছরে ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন দেশে৷  সবচেয়ে বড় এই শ্রমবাজার ধরে রাখতে সৌদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার একটি চিন্তা সব সরকারেরই থাকে৷ 

কিন্তু এই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে গত কয়েক বছরে সরকার একটু বেশিই যেন হেলে পড়ছে দেশটির দিকে৷ চলতি বছরের মার্চে বিতর্কিত সামরিক চুক্তি করেছে, যার মধ্য দিয়ে বলতে গেলে ইয়েমেনে সৌদি আরবের আগ্রাসনকে এক ধরনের সমর্থন দিয়েছে বাংলাদেশ৷ বিনিময়ে সৌদি বাদশাহ ও প্রিন্সের পাঠানো মন্ত্রীরা এসে বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিয়োগ চুক্তি করেছে৷

সৌদি সরকার সম্প্রতি তার অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে৷ বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে তারা ভারত, পাকিস্তানে৷ যে দৌড়ে শামিল হয়েছে বাংলাদেশও৷ দেশটির শ্রমবাজার এবং এই বিনিয়োগ ধরতে গিয়ে শ্রমিক নিগ্রহের ঘটনাকে আর বড় করে দেখতে পারছে না সরকার৷ সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ে দেশটির রাজতন্ত্রকে খুশি রাখাও গুরুত্বপূর্ণ সরকারের কাছে৷ তারই বলি হচ্ছেন বাংলাদেশে নারী শ্রমিকরা?

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

DW Mitarbeiterportrait | Faisal Ahmed
ফয়সাল শোভন ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক৷@FaisalShovon14
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য