1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন: বাস্তবতা ও বিবেচ্য

১৬ এপ্রিল ২০১৯

মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দাখিল মাদ্রাসায় স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে গত ২৪ মার্চ৷ দেশব্যাপী এ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, উচ্ছ্বাস কম ছিল না৷

https://p.dw.com/p/3Gj8V
প্রতীকী ছবিছবি: Getty Images/AFP/I. Mukherjee

দেশের ২২ হাজার ৯৬১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দাখিল মাদ্রাসায় স্কুল কেবিনেট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এর মধ্যে, ১৬ হাজার ২৪৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৬ হাজার ৭১৬টি দাখিল মাদ্রাসা৷ মাধ্যমিক পর্যায়ে এক লাখ ২৯ হাজার ৯৬০টি পদের জন্য দুই লাখ ৩১ হাজার ১২৬ এবং মাদরাসা পর্যায়ে ৫৩ হাজার ৭২৮টি পদের জন্য ৯৩ হাজার ৭১০ শিক্ষার্থী এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে৷

স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচনের উদ্দেশ্য অনেকে পূর্ণাঙ্গভাবে জেনে দায়িত্ব পালন করেছে, কেউ না জেনে করেছে৷ তবে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত স্টুডেন্টস কেবিনেট ম্যানুয়াল-২০১৫'এ স্টুডেন্টস কেবিনেট গঠনের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে:

২.১. শিশুকাল থেকে গণতন্ত্রের চর্চা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া

২.২. অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন

২.৩. বিদ্যালয়ের শিখন শিখানো কার্যক্রমে শিক্ষকমন্ডলীকে সহায়তা করা

২.৪. বিদ্যালয়ে ১০০% ছাত্র ভর্তি ও ঝরে পড়া রোধে সহযোগিতা করা

২.৫. শিখন শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করা

২.৬. বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকান্ডে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা

এখন জানা দরকার নির্বাচিত কেবিনেট মেম্বারদের দায়িত্ব কী?

– পরিবেশ সংরক্ষণ (বিদ্যালয়,আঙিনা ও টয়লেট পরিষ্কার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা)

– পুস্তক এবং শিখন সামগ্রী

– স্বাস্থ্য

– ক্রীড়া ও সংস্কৃতি

– পানি সম্পদ

– বৃক্ষ রোপন ও বাগান তৈরি ইত্যাদি

– অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন

– তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি

উপরোক্ত আটটি খাতে নির্বাচিত আট জন প্রতিনিধি দায়িত্ব পালন করবেন৷ নির্বাচিত ৮ জন বসে একজনকে তাদের কেবিনেট প্রধান নির্বাচন করবেন এবং প্রতি শ্রেণি থেকে ২ জন করে তাদের সহযোগী মনোনীত করবেন৷ এক্ষেত্রে কেবিনেট মেম্বারের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৮ জনে৷

শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের বিকাশ, গণতন্ত্রের চর্চা ওগণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের সকল মাধ্যমিক ও দাখিল মাদ্রাসায় ‘স্টুডেন্টস কেবিনেট' নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷

প্রশ্ন হলো, জীবন গঠনের জন্য স্কুলজীবনে একজন ছাত্রের কত ধরনের মূল্যবোধ শেখানো প্রয়োজন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবস্থান সেখানে কততম? বাচ্চাদেরকে সমাজের সকল নৈতিকতা, মূল্যবোধের চর্চা আমরা করাতে পেরেছি কি না? স্কুলের শিক্ষকদের সেভাবে গড়ে তুলেছি কিনা? তা না করে শুধু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শেখাতে যদি চেষ্টা করা হয়, তবে সেখানে ভাল ফল নাও আসতে পারে, বরং ফল হতে পারে উলটো৷

আদিকাল থেকে তো স্কুলে শ্রেণি প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো এবং শিক্ষকবৃন্দ এতে নেতৃত্ব দিতেন৷ ক্লাসের ভদ্র, উদ্যমী, সংগঠক, মেধাবীদের মধ্যে থেকে এক/দুই জন শ্রেণি প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো৷ শিক্ষকদের আয়ত্বাধীন ছিল ঐ সকল শ্রেণি প্রতিনিধি৷ স্টুডেন্টস কেবিনেট ম্যানুয়ালে যেগুলো বলা হয়েছে তার চেয়েও অধিক কিছু শেখানো হতো৷

বর্তমানে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এমনও হয়েছে যে নির্বাচিত কেবিনেট প্রতিনিধি শিক্ষকবৃন্দের অনুগত না; ছাত্রদের নিকট অনুকরণীয়, মাননীয় না; আদর্শের ধারক না; সকল ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসহ স্কুলের অনেক কল্যাণ সাধন সম্ভব হয়নি, সমস্যা আরও বেড়েছে৷

স্টুডেন্টস কেবিনেটের জন্য কোনো বাজেটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি৷ তবে তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি ও স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা নেয়া যাবে বলে নির্দেশনায় বলা হয়েছে৷ এতে উন্নয়নের নামে সংশ্লিষ্ট হাট-বাজার, সমাজের অর্থবানদের, এমনকি স্কুলের ছাত্রদের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহ করা শুরু হতে পারে৷ কোমলমতি বাচ্চারা এ ধরনের অর্থ সংগ্রহের এ প্রক্রিয়ায় জড়িত হতেই পারে৷ তবে তা কোনোভাবেই মঙ্গলজনক বা সুখকর হবে না৷

ছাত্রদের ভবিষ্যৎ গঠনে স্কুল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়৷ এখানে পড়াশুনার পাশাপাশি নম্রতা, ভদ্রতা, ভালো আচরণ, বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ করা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, সমাজের প্রতি দায়িত্ব, সমাজের সকলের প্রতি সমব্যথী, দেশের প্রতি গভীর মমত্ব ও দেশপ্রেম চাষের সময়৷ যদি ঐ সকল গুণাবলীর জন্ম না হয়, লালন না হয়, তাহলে শুধু স্কুল কেবিনেটের সদস্য নির্বাচিত হয়ে জীবনে কোনো লাভ হবে না৷

এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে সমাজের অনেক নেতিবাচক উপাদান (যেমন স্কুলের পরিচালনা পরিষদ ও দলীয় প্রভাব কিংবা হস্তক্ষেপ, শিক্ষকদের পছন্দ-অপছন্দ, মতামত, স্থানীয় ছাত্র রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি, প্রভাবশালীর ছেলেমেয়েকে প্রার্থী করা ইত্যাদি) জড়িত হয়েছে৷ ফলে এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে৷ প্রশ্নবিদ্ধ এমন প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়তে সহায়ক হবে কিনা তা নিয়ে হাজারও প্রশ্ন তোলা যায়৷

Dr. Md. Aminul Haque
ড. মো. আমিনুল হক, অধ্যাপক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: privat

তরুণ প্রজন্মকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শেখাতে চাই ভালো কথা৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, পরবর্তী প্রজন্ম কি সমাজের জন্য, জীবনের জন্য অপরিহার্য ও অবশ্যই শিক্ষণীয় সকল মূল্যবোধ শিখেছে? আমরা কি শেখাতে পেরেছি? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিখন, লালন কি পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়েছি? গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরমতসহিষ্ণুতা কি শিখিয়েছি? যদি না হয়ে থাকে তবে ক্ষমতার লোভ, নির্বাচিত সদস্য হবার চিন্তা যেন কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের গ্রাস না করে৷

নিজে দেখেছি, কীভাবে প্রার্থী নির্বাচনে এলাকাপ্রীতি, দলীয় টান, প্রভাবশালীদের সন্তান-আত্মীয়প্রীতি, গভর্নিং বডির খায়েশ পূরণের প্রচেষ্টা চলেছে৷ সহপাঠী বন্ধু, পাড়ার প্রতিবেশী, স্কুলের বড়ভাইদের মধ্যে ভেদাভেদ, দূরত্ব, দ্বন্দ্ব, মনোমালিন্য তৈরি হয়েছে৷ আরও মর্মাহত হয়েছি যে কিছু ছাত্র পরবর্তী বছর কীভাবে নির্বাচিত হওয়া যাবে তার কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত৷ পড়াশুনা তাদের কাছে গৌণ! সাংঘাতিক!

আর নির্বাচিতদের দেখেছি নির্বাচন পরবর্তীতে ‘কি হনুরে' ভাব ধারণ করে পড়াশুনায় গোল্লা৷ বিভিন্ন কারণে বহু নির্বাচিত ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনা বন্ধ হয়েছে এবং সাংসারিক জীবনযাপন করছে বর্তমানে৷ কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক ঐ মনোমালিন্য অনেকের আজও আছে৷

নির্বাচনের মাঝে প্রতিযোগিতা আছে, দলাদলি আছে, প্রচারণা আছে, পক্ষ-বিপক্ষ আছে, প্রভাব বিস্তার এর প্রসঙ্গ আছে, বিত্তবান বা সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের ছেলেমেয়েদের কেবিনেটে যাবার প্রবণতা আছে৷ নির্বাচন-প্রচারণায় সময় ব্যয়ের বিষয় আছে৷ ক্ষমতার ব্যবহার/অপব্যবহার আছে৷ পড়ালেখার সময়ক্ষেপণ আছে, হার-জিত আছে, মনোমালিন্য আছে৷ শুনেছি, পত্রপত্রিকায় পড়েছি মারামারিও হচ্ছে, ভোট প্রদানে বল প্রয়োগ হয়েছে/আছে৷ তাহলে, ভালো কী কী আছে এ প্রক্রিয়ায়? কী কী ভালো চিন্তা করে এ নির্বাচন ব্যবস্থা শুরু করা হয়েছিলো তা সবিস্তার গবেষণার বিষয়৷

পাওয়া, না পাওয়ার হতাশা থাকবে, ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার থাকবে; সবগুলো কি আমরা সমাধান করতে পারব? সবগুলো কি ছাত্র-ছাত্রীদের উপকারে আসবে?

যে সকল বিষয়গুলো সমাজের দলীয়করণে প্রভাবিত করবে৷ দলীয় প্রধানদের সন্তানরা নির্বাচনে যাবে, গরিব মেধাবীরা স্থান পাবে কিনা? ক্লাসের ভদ্র, মেধাবী, কর্মঠ, উদ্যোমী ছাত্র-ছাত্রীটি বাদ পড়বে নাতো? কেউ নির্বাচিত হবার পরে যদি ক্লাসের কিংবা স্কুলের ছেলে-মেয়েদের আদর্শ, ভদ্র, নম্র ও ভালো নৈতিকতার প্রতিনিধিত্ব না করে, সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা কী করবেন তখন? ছাত্র-ছাত্রীরাই বা কী করবে তখন?

নৈতিকতা, মুল্যবোধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নম্র, ভদ্র আচরণ শেখাতো স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্যই পালনীয় একটা শিক্ষা৷ স্কুল পরিষ্কার রাখা, নিজের জামা কাপড় পরিষ্কার রাখা, সমাজের মানুষের উপকার করা, বড়দের সম্মান করা, স্কুলে বাগান করা, সমাজের মঙ্গল সাধন করা, পারস্পরিক সহমর্মিতা জাগানো, সমাজের প্রতি অধিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা৷ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করাই তো সকল ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্য পালনীয় নিয়মিত কাজ৷ ভাত খাওয়া, কাপড় পরা, গোসল করার মতো নিয়মিত কাজ৷ বাস্তব প্রেক্ষিতে কেবিনেট গঠন বা নির্বাচন ছাত্রদের কতখানি মঙ্গল বয়ে এনেছে তা বিচার বিশ্লেষণ করা খুবই জরুরি৷ অতি দ্রুত সার্বিক সুফল- কুফল বিবেচনা করে স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন  প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য৷

ড. মো. আমিনুল হক, অধ্যাপক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান