1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ, একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ

সাংবাদিক
মাসুদ কামাল
৬ অক্টোবর ২০২৩

সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে, বা আহত হলে একটা পরিবারের ওপর দিয়ে কতটা বিপর্যয় নেমে আসে, সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। উন্নত অনেক দেশেই বিমা ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এভাবে সরাসরি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম সম্ভবত নেই।

https://p.dw.com/p/4XBRr
বাংলাদেশে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাতে টাকায় কি সংকুলান হবে
বাংলাদেশে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাতে টাকায় কি সংকুলান হবেছবি: Nazmul Hasan

একসময় আমি নিয়মিত মোটরবাইক চালাতাম। সেটা দু'দশকেরও বেশি আগের কথা। ঢাকায় যানজটের অবস্থা তখন এতোটা ভয়াবহ ছিল না। তারপরও আমরা যারা রিপোর্টার ছিলাম, আমাদের যাতায়াতের জন্য বাইক ছিল সর্বোত্তম বাহন। রাস্তায় বাইকচালকদের সে সময় নিয়মিত কিছু বিরূপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হতো। মাঝে মধ্যেই রাস্তার মোড়ে দেখা মিলতো ট্রাফিক সার্জেন্টদের। হাত তুলে বাইক থামাতো, কাগজপত্র দেখতে চাইত। এই কাগজপত্রের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কাগজটিতে সমস্যা থাকত সেটা হচ্ছে ইন্সুরেন্সের কাগজ। দেখা যেত বাইকের লাইসেন্স, চালকের লাইসেন্স-এসব ঠিক আছে। ইন্সুরেন্সের কাগজটি আছে, তবে এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অগত্যা মামলা, জরিমানা, ইত্যাদি ঝামেলা।

আমি নিজেও ইন্সুরেন্স নিয়মিত করতাম না। না করারও কারণ আছে। একবার ময়মনসিংহ গেলাম, রিপোর্টিংয়ের কাজেই। সেটা সম্ভবত ২০০০ সালের কথা। তখন আওয়ামী লীগের শাসনামল। ছাত্রদলের কয়েকজনকে বেদম প্রহারেরকী যেন একটা ঘটনা ছিল। আমি জেলা ছাত্রদলের অফিসে বসে ওদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। অফিসের বাইরে আমার বাইকটি দাঁড় করানো ছিল। ছাত্রলীগের একটা মিছিল এলো। এলোপাথাড়ি ভাঙচুর করল। আমার নিরীহ বাইকটিতে আগুন ধরিয়ে দিল। আমি তখন জনকণ্ঠে। জনকণ্ঠ তখন প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতো। কে একজন বিষয়টি বলতেই, ছাত্রলীগের ছেলেরাই তখন আগুন আবার নিভিয়ে ফেলল। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি অনেকটাই হয়ে গেছে। এর কিছুদিন আগেই আমি বাইকের ইন্সুরেন্স নবায়ন করেছি। তাই ঢাকায় ফিরে বিমা কোম্পানিতে যোগাযোগ করলাম।

তারা বলল, আমি তো কোনো ক্ষতিপূরণ পাব না। কারণ—আমার বাইকের যে ইন্সুরেন্সটা করা হয়েছে সেটা নাকি থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্স!

এই ‘থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স' বিষয়টা সম্পর্কে আমি তখনই প্রথম শুনলাম। আমার বিস্মিত ভাব দেখে বিমা কোম্পানির ভদ্রলোক আমাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন। জানতে পারলাম- যানবাহনের ক্ষেত্রে দুই ধরনের বিমা হয়। ফার্স্ট পার্টি এবং থার্ড পার্টি। যানবাহন এবং মালিকের ক্ষতির জন্য প্রথমটি এবং দুর্ঘটনার কারণে যদি পথচারী বা তৃতীয় কারো ক্ষতি হয় তাহলে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সের আওতায় সে ক্ষতিপূরণ পাবে। সেকেন্ড পার্টি ইন্সুরেন্স বলে আদৌ কিছু আছে কি-না, তিনি তা বলেননি। আমি কেন জানতে চাইনি, এতদিন পর সেটাও মনে নেই। তবে তিনি জানিয়েছিলেন, এই দুই ধরনের ইন্সুরেন্সের প্রিমিয়ামের হারেও রয়েছে বিশাল পার্থক্য। মোটরবাইকের জন্য থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্সের প্রিমিয়াম ছিল বছরে ২৬০ টাকা বা এর আশপাশে কিছু একটা। আর ফার্স্ট পার্টি ইন্সুরেন্সের প্রিমিয়াম ছিল প্রায় ৫ হাজার টাকা।

এই যে তিনশ টাকারও কম প্রতিবছর বিমা কোম্পানিগুলোকে দেওয়া, এর বিনিময়ে আসলেই কি তারা দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত কোনো তৃতীয় পক্ষকে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতো? এই প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে তখন আমি একটি রিপোর্টও করেছিলাম জনকণ্ঠে। তখনই কিছু হতাশাজনক তথ্য পেয়েছিলাম। জানতে পেরেছিলাম-থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্সের আওতায় ক্ষতিপূরণের সর্বোচ্চ পরিমাণ হচ্ছে ২০ হাজার টাকা!অর্থাৎ আপনার গাড়ির দুর্ঘটনার কারণে যদি কোনো পথচারীর মৃত্যুও হয়, তিনি যদি ক্ষতিপূরণ দাবি করেন, সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পাবেন। কেবল এটাই নয়, এরও চেয়ে হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে-সাধারণত এধরনের দাবি নিয়ে কেউ বিমা কোম্পানিগুলোর কাছে যায়-ই না। সে সময় আমি পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের একটা হিসাব নিয়েছিলাম, সেই পাঁচ বছরে কোনো বিমা কোম্পানিকেই থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সের ক্লেইম হিসাবে একটি টাকাও পরিশোধ করতে হয়নি।

সবমিলিয়ে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স এমনই একটা বিষয়, যা থেকে যানবাহন মালিক, চালক বা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ-কেউই কোন উপকার পায় না। অথচ এই আইনটি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। ২০২০ সালের আগে পর্যন্ত ঢাকা শহরে মোটরবাইক চালকদের বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে তার ৬০ শতাংশের বেশি ছিল এই ইন্সুরেন্সের কাগজ ঠিকঠাক মতো না থাকার কারণে। অর্থাৎ, এই সময়ের আগে পর্যন্ত লাভটা হয়েছে কেবল বিমা কোম্পানি ও পুলিশের। ২০২০ সালের কথা বললাম একারণে যে, সেবারই আইন করে এই থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্সের বিষয়টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটা বন্ধ করে দেওয়া হয় আসলে তারও দুই বছর আগে নতুন হওয়া সড়ক পরিবহণ আইনের ভিত্তিতে। ২০১৮তে হওয়া সেই আইনে থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্সকে আর বাধ্যতামূলক রাখা হয়নি। তারই আলোকে ২০২০ সালে অকার্যকর এই ইন্সুরেন্সকে বাতিল করা সম্ভব হয়।

বাতিল তো হলো, কিন্তু পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত তৃতীয় পক্ষের জন্য বিকল্প কী ব্যবস্থা রাখা হলো? সে রকম একটা ব্যবস্থা কিন্তু ২০১৮ সালের সেই আইনের মধ্যেই ছিল। বলা হয়েছিল-ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, কিন্তু দেবে কে? কিংবা দেবে কোথা থেকে? এসব প্রশ্নের জবাব পেতে পেতে লেগে গেল আরও দুই বছর। গত বছর, ২০২২ সালে এসে সরকার এ সংক্রান্ত একটা বিধি তৈরি করতে সক্ষম হলো। ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ‘সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ বিধিমালা' প্রকাশ করে সরকার। বিধিমালা অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির যদি চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে তাকে এককালীন তিন লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আর যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে তাহলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে এক লাখ টাকা।

মাসুদ কামাল, সাংবাদিক
মাসুদ কামাল, সাংবাদিকছবি: Hashibur Reza Kallol

সন্দেহ নেই, নিয়মটি ভাল। আগে যেখানে এক টাকাও কেউ পেত না, আর দাবি করলেও ২০ হাজার টাকার বেশি পাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না, সেখানে তিন লাখ বা এক লাখের অঙ্কটা অবশ্যই মন্দ নয়। এ তো গেল আহতের জন্য ক্ষতিপূরণ। আর মারা গেলে? নিহতের জন্য ক্ষতিপূরণের অঙ্কটা রাখা হয়েছে পাঁচ লাখ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, টাকাটা আসবে কোথা থেকে?

কে দেবে? কিভাবে দেবে? বিধিমালায় সে বিষয়গুলোও স্পষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য একটা তহবিল করা হবে।

এ ছাড়া বিধিমালায় তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কেও বলা আছে। এই তহবিলে মোটরযান মালিক প্রতিটি মোটরযানে বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে বার্ষিক বা এককালীন চাঁদা দেবেন। এ তহবিল গঠনে মোটরসাইকেলের মালিককে এককালীন ১০০০ টাকা দিতে হবে। বাস, ট্রাক, কভার্ড ভ্যান ও প্রাইম মুভারের জন্য বার্ষিক দেড় হাজার টাকা দিতে হবে। মিনিবাস, মিনি ট্রাক ও পিকআপের জন্য বার্ষিক ৭৫০ টাকা ধার্য হয়েছে। কার, জিপ ও মাইক্রোবাসের জন্য বার্ষিক ৫০০ টাকা দিতে হবে। আর থ্রি-হুইলার ও অন্যদের বার্ষিক ৩০০ টাকা দিতে হবে। মোটরসাইকেল ছাড়া অন্যান্য যানের চাঁদা দেওয়ার নির্দিষ্ট মেয়াদ চলে গেলে প্রতি মাস বা মাসের অংশবিশেষের জন্য ৫০ টাকা হারে অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে অর্থ সংগ্রহের যে পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে, আর আমাদের দেশে যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাতে টাকায় কি সংকুলান হবে? এনিয়ে একটা হিসাবও এরই মধ্যে করা হয়েছে। দেখা গেছে-দেশে যত যানবাহন আছে, তা থেকে বিধিমালার হিসাব অনুযায়ী বছরে বড়জোর দেড়শ' কোটি টাকা আসতে পারে। আর বিপরীত দিকে দুর্ঘটনা যে হিসাব সরকারি পর্যায়ে আছে, তাতে নিহত আর আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে দরকার পড়বে কমপক্ষে চারশ' কোটি টাকা। অনেকে অবশ্য পার্থক্যটিকে আরও একটু বড় হিসাবে দেখছেন। তাদের মতে, সরকারি অর্থাৎ বিআরটিএর হিসাবের চেয়েও অনেক বেশি মানুষ দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে থাকে। বেসরকারি সে হিসাবে প্রতিবছর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য দরকার পড়বে কমপক্ষে আটশ' কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে তহবিল সংগ্রহের উৎস আরও বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে সরকারের তহবিল থেকেও দেওয়া যেতে পারে।

এ বছরের শুরু থেকে এই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের কর্মকাণ্ড চালু হয়ে গেছে। বেশ কিছু আবেদন জমা পড়েছে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩১০টি আবেদনপত্র জমা পড়েছে। সেগুলো থেকে ৬৩টির অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এর মধ্যে নিহত ৩৮ জনের পরিবার ও আহত ২৫ জন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য বলে প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছে। এ মাসের ২২ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থদের পরিবারের সদস্যদের কাছে

সেই ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তরও করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে চেক হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন।

সব মিলিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের পরিবারকে সাহায্য করার এই যে নতুন উদ্যোগ এটা আমার কাছে ভালো লেগেছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন ব্যবস্থা আছে বলে আমার জানা নেই। উন্নত অনেক দেশেই বিমা ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এভাবে সরাসরি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম সম্ভবত নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে, বা আহত হলে একটা পরিবারের ওপর দিয়ে কতটা বিপর্যয় নেমে আসে, সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। সেই ক্ষতির বিনিময় হয়তো অর্থ দিয়ে করা যায় না। কিন্তু এটাও সত্য যে, বিপর্যস্ত সেই সময়ে এই টাকাটা অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পারে।

তবে ভালো এই উদ্যোগটি নিয়ে দুটি উদ্বেগ আমার রয়েছে। প্রথমত হচ্ছে, পর্যাপ্ত তহবিল গঠন। কোথা থেকে আসবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ। সরকারি তহবিল থেকে শুরুর দিকে কিছু দিতেই হবে। পরে হয়তো বিকল্প উৎসগুলো দিকে তাকানো যেতে পারে। কিন্তু প্রথম কয়েক বছর বাজেটে এর জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখা যেতে পারে।

শুরুর পরেই যদি এটি অর্থাভাবে থমকে যায়, তাহলে এনিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহও কমে যাবে। আর দ্বিতীয় উদ্বেগটি হচ্ছে—প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের নির্বাচন করা আর ক্ষতিপূরণ পেতে তাদেরকে ভোগান্তির হাত থেকে মুক্ত রাখা। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ব্যবস্থায় তা কতটুকু সম্ভব হবে-সেটাই এখন দেখার বিষয়।