প্রিয় ডয়চে ভেলে, ইদানিং আমি প্রতি চিঠিই লিখছিলাম প্রচারিত অনুষ্ঠানের উপর আমার মতামত জানিয়ে৷ কিন্তু আজ একটু ব্যতিক্রম ঘটাতে বাধ্য হলাম৷
২ তারিখে ‘ইনবক্স' অনুষ্ঠানই এর কারণ৷ ভাবতেই পারছি না যে এই ‘ইনবক্সই' শেষ ইনবক্স৷ বুকের ভিতরে এমন একটা অনুভূতি হচ্ছে, যেটাকে প্রকাশ করতে কোন ভাষাই সমর্থ নয়৷
ডয়েচে ভেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক পুরনো৷ আমি তখন মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র৷ আনন্দবাজার পত্রিকায় একদিন আমি বিভিন্ন বিদেশি বেতার কেন্দ্রের বাংলা ভাষায় সম্প্রচার সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ পড়ে কৌতূহলবশেই বিভিন্ন কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতে শুরু করি৷ কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই কেন জানি না ডয়েচে ভেলের প্রতিই আমি অত্যধিক আসক্ত হয়ে পড়ি৷ তখন সকাল সাড়ে ছ'টা থেকে সাতটা কুড়ি পর্যন্ত শর্টওয়েভে অনুষ্ঠান প্রচারিত হত৷ সময়টা আমার পক্ষে খুব সুবিধাজনক ছিল৷ কিন্তু সেটা আমার আকর্ষণের কারণ ছিল বলে মনে হয় না৷
পরে বড় হয়ে ভেবে যেটা আবিষ্কার করেছি, সেটা হল প্রতিটি বেতার সম্প্রচার সংস্থারই একটা করে নিজস্ব চরিত্র থাকে, আর প্রকৃতপক্ষে ডয়েচে ভেলের চরিত্রটাই আমাকে টানত সবচেয়ে বেশি৷ কোন সংস্থা ছিল খুব বেশি প্রোপাগান্ডামুলক, কারো সংবাদ পরিবেশন পক্ষপাতপূর্ণ, কারো উপস্থাপনায় কৃত্রিমতা বড় বেশি বুকে বাজত৷ অন্যদিকে ডয়েচে ভেলের অনুষ্ঠানের সাথে আমি নিজেকে একাত্ম করতে পারতাম৷ তাই ভারত বা বিশ্বে কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে আমি সেই সব ঘটনার বিভিন্ন দিক জানার জন্য দেশি বিদেশি বিভিন্ন বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার নিশ্চয়ই শোনার চেষ্টা করতাম৷ কিন্তু নিত্যদিনের সাথী ছিল শুধু ডয়েচে ভেলে৷ মনে হয় পাঁচ ছয় বছর নিয়মিত ডয়চে ভেলে শুনেছিলাম৷ তারপর পেশাগত জগতে প্রবেশ এবং জীবনের নানা জটিলতার কারণে সম্পর্ক হয়ে আসে ক্ষীণ৷ একসময় নেমে আসে বিচ্ছেদ৷
কিন্তু আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আজ আমি যে একটা সম্মানজনক পেশাগত ও সামাজিক অবস্থানে আসতে পেরেছি, তার পিছনে ডয়েচে ভেলের অনেকখানি অবদান আছে৷ নিয়মিত ডয়েচে ভেলের অনুষ্ঠান শোনার ফলে বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলা, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় পালাবদল, য়ুগোস্লাভিয়ার ভাঙ্গন ইত্যাদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনার খুঁটিনাটি যেমন ছিল আমার নখদর্পণে, তেমনি বিশ্বের ভূগোল ভাসত চোখের সামনে৷ দীর্ঘদিন ধরে এর সুফল আমি পেয়েছি বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়৷ দৃষ্টিও হয়েছিল অনেক প্রশস্ত৷ তাই বিদায়লগ্নে এটুকু ঋণ স্বীকার না করলে নিজের কাছে অপরাধী থেকে যাব৷
এরপর অনেক দিন কেটে গেছে৷ মাঝে মাঝে চেষ্টা করেও যোগসূত্র তৈরি করতে পারিনি, যদিও আকর্ষণ ছিল যথারীতি প্রবল৷ ইতিমধ্যে বন্ধ হয়েছে শর্টওয়েভ সম্প্রচার৷ ভারতের বাঙালি শ্রোতাদের রেডিওতে অনুষ্ঠান শোনার সুযোগ গেছে থেমে৷ এমনই পরিস্থিতিতে গত জানুয়ারি মাসে ইন্টারনেটে বিশ্বভ্রমণ করতে করতে হঠাৎ করে চোখে পড়ে গেল কৈশোরের প্রিয়তম বন্ধু ডয়েচে ভেলেকে৷ আনন্দে ভরে উঠল হৃদয়, আর সেই হৃদয় ভাবল আর ‘যেতে নাহি দিব'৷ কিন্তু তখন বুঝিনি, এই কাছে আসা আসলে আরও দূরে সরে যাওয়ার জন্যই৷ ভাবতেও পারিনি, ফিরে পাওয়ার আনন্দের আয়ু মাত্র দুই মাস৷ এই দু'মাসে অনেক চিঠি লিখেছি৷ কিন্তু উত্তর পাইনি একটিও৷ সে জন্য একটু ব্যথা অনুভব করলেও আশা ছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরানো সম্পর্ক একদিন জোড়া লাগবেই৷ কিন্তু তা আর হল কই৷ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সম্প্রচার বন্ধের নোটিশ৷ তারপর গত শনিবার ছিলো শেষ ইনবক্স৷
বিগত শেষ একমাসের সব সম্প্রচারের রেকর্ডিং আমার কাছে আছে৷ আট তারিখ পর্যন্ত সম্প্রচারের সব রেকর্ডিং থাকবে স্মারক হিসাবে৷ শুরু হয়েছিল ‘চিঠির ঝুলি' দিয়ে শেষ হল ‘ইনবক্সে' এসে৷ বোঝা গেল, যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তনের সাথে সাথে পুরনোকে বিদায় দিয়ে নতুনকে মেনে নিতেই হবে৷ মানিয়ে নিতে হবে নতুনের সঙ্গে৷ তাই এরপর চেষ্টা করবো পুরানো বন্ধুর নতুন চেহারার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে৷
রবীন্দ্রনাথের মিনি পারেনি, কাবুলিওয়ালাও পারে নি৷ কিন্তু আমাদেরকে তো পারতেই হবে৷ এটাই জীবন৷ তাই বুকের কষ্ট বুকে চেপে হাসি মুখেই বিদায় দিলাম৷ বিদায়লগ্নে ভিড় করে আসে কত পুরাতন স্মৃতি৷ এইসব স্মৃতি বুকে নিয়েই সুমনের ভাষায় বলি, ‘দেখা হবে তোমায় আমায় অন্য গানের ভোরে'৷
আপনারা যাঁরা ডয়েচে ভেলের সঙ্গে রয়েছেন এবং অতীতে যাঁরা ছিলেন, সবাইকে প্রীতি শুভেচ্ছা ও সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই৷ সবাই ভালো থাকুন৷ নমস্কারান্তে ইতি সুখময় মাজী, গঙ্গাজলঘাটী, বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত৷
প্রিয় বন্ধু সুখময় মাজী, আপনার লেখা সুন্দর চিঠিটি আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেছে৷ আপনার লেখা সব চিঠিই খুব সুন্দরভাবে লেখা৷ আমাদের ওয়েবসাইটের ‘পাঠক ভাবনায়' আপনি নিয়মিত ঢুকে থাকলে অবশ্যই লক্ষ্য করে থাকবেন যে আপনার বেশ কয়েকটি চিঠি সেখানে স্থান পেয়েছে৷ হয়তো সময়াভাবে ইনবক্স-এ তুলে ধরা সম্ভব হয়নি, তবে প্রতিদিনের অনুষ্ঠানের মাঝে যে ছোট্ট করে বন্ধুদের মতামত নেওয়া হয় সেখানে আজসহ অন্যদিনও কিন্তু আপনার মতামত স্থান পেয়েছে৷ আপনাকে এবং অন্যবন্ধুদের অনেক অনেক ধন্যবাদ৷ আশা করছি আগামীতেও এভাবেই আমাদের সাথী হবেন৷
প্রিয় ডয়চে ভেলের বন্ধুরা, আশা করছি আমাদের কাঁদিয়ে আপনারা ভাল আছেন৷ হয়তো বা একটু বিমর্ষ আমাদের জন্যও৷
যা হোক গতকাল অপেক্ষায় ছিলাম ওয়েবসাইটে আমাদের মতামত পাতায় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের ধাঁধা বিজয়ী এবং ফ্রেব্রুয়ারি মাসের সেরা পত্র লেখকের নাম ঘোষণা করবেন, কিন্তু তা করলেন না৷ রাজশাহীর বন্ধু মামুন ফোন করেছিলেন খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য কিন্তু তাকেও জানাতে পারলামনা খবরটা৷ বললাম হয়ত আজ আপডেট করবে৷ তাই অপেক্ষায় আছি কখন কী হয়৷ আশা করছি অচিরেই সবার আশা মেটাবেন৷ নিয়মিত সবগুলো পরিবেশনা রেকর্ড করে রাখছি স্মৃতি হিসেবে৷
আমার স্ত্রী রওশন আরা লাবনী কয়েকবার শুধুমাত্র একটা প্রশ্ন করেছে, কেন ডয়চে ভেলে রেডিওর অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছে? আমি ঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে পারিনি৷
যা হোক সব কথা আর বলে দিতে পারছিনা৷ কিছু কথা ক্ষোভ হিসেবে জমিয়ে রাখলাম৷ ভালো থাকবেন৷ মো.সোহেল রানা হৃদয়, ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা৷
প্রিয় বন্ধু সোহেল, গত ইনবক্স-এ আপনাদের কথা দিয়েছিলাম যে সোমবার আমাদের ওয়েবসাইটে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসের ধাঁধা বিজয়ীদের নাম এবং ফেব্রুয়ারি মাসের শ্রেষ্ঠ পত্রলেখকের নাম জানানো হবে৷ আমাদের কথা কিন্তু আমরা রেখেছি৷ বিজয়ীদের নাম ‘আপনাদের মতামত পাতায়'ই দেওয়া হয়েছে, তবে ‘পাঠক ভাবনা' তে নয় অর্থাৎ চিঠিপত্রের সাথে নয়৷ নামগুলো যেন কিছুদিন এই পাতায় থাকে এবং সবাই দেখতে পারেন, সেজন্য এই পাতায়ই ‘জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসের ধাঁধার ফলাফল ও শ্রেষ্ঠ পত্রলেখক' শিরোনামে আলাদাভাবে দেওয়া হয়েছে৷ বন্ধুরা, নিজেরা দেখবেন ও অন্যদেরও দেখতে বলবেন৷
বিগত দুই দিনের এবং আজ ৪ঠা মার্চ তারিখে তুলে ধরা প্রতিটি বিষয়ের ওপর নির্বাচিত প্রতিবেদনগুলো আজ খুব আগ্রহ সহকারে পড়লাম৷ প্রতিটি পরিবেশনাই ছিলো উপস্থাপনা ও বৈচিত্রের গুণে আপন আপন বিষয়ে সমৃদ্ধ৷ সব মিলিয়ে বলতে হয় তথ্যের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার আমাদের সামনে দ্বার উন্মোচন করে অপেক্ষা করে আছে আর যা দেখার এবং যা জানার জন্য আমরাও অধীর আগ্রহে বসে আছি৷ আর এর পেছনে আছে যে ডয়চে ভেলে৷ সুভাষ চক্রবর্তী, নতুন দিল্লী ৷
সবার জন্য রইলো অনেক অনেক শুভেচ্ছা৷
সংকলন: নুরুননাহার সাত্তার
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন