1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘ঘৃণা' ছড়ালে লাভ হয় ক্ষমতাবান বা বিশেষ গোষ্ঠীর

২৭ মার্চ ২০১৮

ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়িয়ে নানান ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হয়, তাই সামগ্রিকভাবে ঘৃণা হলো প্রভাবশালীদের এক রকমের হাতিয়ার৷ এর বাইরে এককভাবে যারা ঘৃণা ছড়ান, তারা কুশিক্ষা বা কুচেতনার বশবর্তী হয়ে এমন করেন বলে মত বিশ্লেষকদের৷

https://p.dw.com/p/2v0nW
Symbolbild Bangladesch Mann mit Handy in Dhaka,
ছবি: Getty Images/AFP/J. Samad

ঘটনা এক

ক'দিন আগেই ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা হলো৷ ধরা পড়লেন হামলাকারী৷ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে হামলাকারী দাবি করলেন যে, অধ্যাপক ইকবাল ইসলামবিদ্বেষী৷ তাই তাঁর ওপর হামলা করা হলো৷

এই ঘটনায় সামাজিক গণমাধ্যমজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা গেল৷ বেশিরভাগ মানুষই ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু এর বাইরেও অনেকে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থনও করেছেন৷ অনেকেই ড. জাফর ইকবালকে নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যও করেছেন৷

ঘটনা দুই

২০১৭ সালের নভেম্বরে ফেসবুকে ধর্মীয় কটূক্তির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রংপুরে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে৷

টিটু রায় নামে জনৈক ব্যক্তি যিনি ফেসবুকে ধর্মীয় কটূক্তি করেছেন বলে ছড়ানো হয়, দেখা যায়, তিনি রংপুরেই থাকেন না পাঁচ বছর ধরে৷ থাকেন ঢাকায়৷ আর পড়াশুনা জানেন না৷ ফেসবুকে এমন কটূক্তি তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়৷

অথচ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়৷ এ সময় পুলিশ ও সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘর্ষে এক যুবক নিহতও হন৷ আহত হন অর্ধশতাধিক৷

দেশে এমন ঘটনা নতুন নয়৷ ২০১৬ সালের অক্টোবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগরে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে৷ ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধমন্দির পোড়ানো হয়৷ সবগুলো ঘটনাতেই ফেসবুকে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর পোড়ানো, মন্দির জ্বালিয়ে দেয়া হয়৷

ঘটনা তিন

২০১৬ সালের আগষ্টে কলকাতার নজরুল মঞ্চে ছিল ‘স্বাধীনতা কনসার্ট'৷ সেখানে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিল বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলস৷ কলকাতার ব্যান্ড ফসিলসেরও সেখানে গান গাওয়ার কথা ছিল৷

কিন্তু হঠাৎ করেই বেঁকে বসলেন ফসিলসের ভোকাল রূপম ইসলাম৷ মাইলসের শাফিন ও হামিন আহমেদের ‘ভারতবিরোধী' বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এক মঞ্চে না গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি৷ এ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিলেন৷

এরপর মাইলসের সদস্যরাও রূপমের ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা' নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷ দুই পক্ষের বিদ্বেষ দুই বাংলার অনেকের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে৷ এই অবস্থা চলতে থাকে বেশ কিছুদিন৷

ঘটনা চার

চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব' চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ৷ এই চলচ্চিত্রটি হুমায়ুন আহমেদের জীবনের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ ছিল হুমায়ূনপত্নী মেহের আফরোজ শাওনের৷ সেই বিতর্কের জেরে শাওনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু করেন অনেকেই৷

তেমনই একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বান্টি মীর৷ তিনি সামাজিক গণমাধ্যমে বেশ কয়েকটি ভিডিও প্রকাশ করে সেখানে আক্রমণাত্মক ও অশালীনভাবে শাওন ও তাঁর পরিবারকে আক্রমণ করেন৷

ঘটনা পাঁচ

২০১৭ সালের ঘটনা৷ ফেসবুকের ‘আনসেন্সরড বিডি' পেজে ছবি পোস্ট করা হয় বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, তাঁর স্ত্রী শিশির, কন্যা অব্রি ও তাদের কাজের মেয়ের৷

সেই ছবিটিতে দেখা যায় যে, সাকিব ও শিশির খাচ্ছেন, এবং তাঁদের পেছনে দাঁড়িয়ে কাজের মেয়ে৷

ছবিটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ অনেকেই কটূ কথা বলতে শুরু করেন সাকিব ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে৷ কেউ কেউ সাকিবের অতীত টেনে নানা রকম অশালীন মন্তব্য করেন৷

কিন্তু পরে জানা যায়, যে ছবিটি পোস্ট করা হয়েছে, তা মূল গল্পের একাংশ৷ সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অন্য ছবিগুলোতে দেখা যায়, মেয়েটি তাদের সঙ্গে একই খাবার টেবিলে বসে আছে৷

‘হেট স্পিচ মানুষের একটি টিকে থাকার কৌশল’

ওপরের ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন৷ প্রত্যেকটির ব্যাপকতাতেও আছে ভিন্নতা৷ কিন্তু একটি বিষয় সবগুলোতেই রয়েছে, তা হলো, প্রতিটি ঘটনাই বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বা হেট স্পিচের এক একটি উদাহরণ৷

বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়৷ বিদ্বেষ ছড়িয়ে নাশকতা তৈরির নজিরও আছে ভুড়ি ভুড়ি৷ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে এই বিদ্বেষ ছড়ানো যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে

এখনকার সময়ে সবচেয়ে বেশি যেটি দেখা যায়, সেটি হলো, সাম্প্রদায়িক বক্তব্য৷ অর্থাৎ ভিন্ন ধর্মের বা মতের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো৷ এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক আফসান চৌধুরী৷ তিনি মনে করেন, হেট স্পিচ দেয়া বা সমাজে ঘৃণা ছড়ানো মানুষের একটি টিকে থাকার কৌশল৷ ঘৃণা ছড়ালে কারো কারো লাভ হয়৷ তাই লাভবান হতেই হেট স্পিচ ছড়ানো হয়৷

‘‘একাত্তরে কিছু মানুষ সুবিধা নেবার জন্য বা লুটতরাজ করার জন্য বিদ্বেষ ছড়িয়েছে৷ কিন্তু গোষ্ঠীগতভাবে মুসলিমরা হিন্দুদের প্রতি বা হিন্দুরা মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষী কখনোই ছিল না৷''

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের টিটু রায় কিংবা ফেনীতে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের পর যেসব ঘটনা ঘটেছে সবই স্থানীয় সুবিধা আদায়ের জন্য হয়েছে বলে মনে করেন আফসান চৌধুরী৷

‘‘দেখবেন, বেশিরভাগ এমন ঘটনার পর জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে৷ স্থানীয় প্রভাবশালীরাই তা করছে৷''

তিনি নিজের গবেষণায় দেখেছেন যে, এসব ঘটনায় স্থানীয় মুসলিমরাই হিন্দুদের আশ্রয় দিয়েছেন৷ তাই তিনি মনে করেন, ধর্মীয় উস্কানি থাকলেও এগুলোতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষয় নেই৷

অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেন যে, প্রভাবশালীরাই বিদ্বেষ টিকিয়ে রেখেছে৷ কারণ, সাধারণ মানুষের বিদ্বেষ করা ছাড়াও রুটিরুজির কাজ করতে হয়৷ তাই বিদ্বেষ টিকিয়ে রেখে লাভ হয় ক্ষমতাবানদেরই৷ কোনো কোনো গোষ্ঠী এই সুযোগ নিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করে৷

তিনি মনে করেন, সারাবিশ্বে সবাই সহিংস বিদ্বেষকেই বড় করে দেখে৷ কিন্তু এই সমাজে অহিংস বিদ্বেষ ছড়িয়ে অর্থনীতি ধ্বংস করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে, সেটি কেউ দেখে না৷

‘আমরা তো জঙ্গলে বাস করছি না’

‘‘আজকে যদি একজন ১ হাজার কোটি টাকা মেরে দিতে চায়, সে যদি ১০ কোটি টাকা বিএনপির বিরুদ্ধে খরচ করে, তাহলে সে দুর্নীতি করে পার পেয়ে গেল৷ কারণ, তখন আওয়ামী লীগের লোকেরা তাকে কিছু বলবে না৷ একই কথা বিএনপি সরকারে এলে তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷'' টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন তিনি৷

শুধু রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক নয়, ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে নারীর প্রতিও বিদ্বেষ দেখা যায় ব্যাপক৷ সেই বিদ্বেষ বিকৃতির পর্যায়েও চলে যায়৷ প্রায়ই লাঞ্ছনার শিকার হওয়া নারীরা ফেসবুকে বা সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার হলে অনেকে পক্ষ নিলেও অনেককেই দেখা যায় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিতে৷

সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী৷ ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, পরিবারেই এই বিষয়গুলোর শিকার হয় নারীরা৷

‘‘নারী আসলে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়৷ পরিবারেই ঠিকমতো এগুলো শেখানো হয় না৷ স্কুলগুলোতেও একই অবস্থা৷'' বলছিলেন তিনি৷

নারীদের প্রতি যে কোনো অত্যাচার হলেই কিছু মানুষকে তাঁদের চরিত্র নিয়ে খুব কথা বলতে দেখা যায়৷ ‘‘এটাতো একেবারে কমন৷'' বলছিলেন সালমা আলী৷ ‘‘শুধু পুরুষরা নয়, এমনকি নারীরাও এ প্রশ্ন তোলেন৷ যেমন, এই বনানীর ঘটনাটার কথা ধরেন, মেয়েগুলো কেন গেল, এটাই প্রশ্ন করছেন তারা৷ আমরা তো জঙ্গলে বাস করছি না যে কোথাও যেতে পারব না৷''

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ জরিপ বলছে, প্রতি পাঁচ জনে একজনের বেশি নারী অনলাইনে হয়রানির শিকার হন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষয়গুলোও বেড়েছে বলে মনে করেন এই মানবাধিকার কর্মী৷

‘‘আইন আছে৷ প্রচলিত আইনেই এসবের বিচার চাওয়া যায়৷ সেই সঙ্গে এখন তো পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট আছে৷'' ঠিকমতো কাজে লাগালে এসব প্রতিহিংসামূলক  বক্তব্য ঠেকানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি৷

গবেষক আফসান চৌধুরী ও আইনজীবী সালমা আলী মনে করেন ‘ঘৃণা' বিষয়টি সমাজের মধ্যে গেঁথে আছে৷ এখান থেকে বেরুতে হলে দরকার সামাজিক কাঠামোগত পরিবর্তন৷ সেই পরিবর্তন তখনই কমবে, যখন রাষ্ট্র সবাইকে সমান সুযোগ দিতে পারবে, এবং ঘৃণা ছড়িয়ে যখন লাভবান হওয়ার পথ সংকীর্ণ হয়ে আসবে৷

হেট স্পিচ বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য কতটা ক্ষতিকর? লিখুন নিচের মন্তব্যের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য