1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
পরিবেশসংযুক্ত আরব আমিরাত

দুবাই জলবায়ু সম্মেলন ও বিমর্ষ পৃথিবী

পাভেল পার্থ
২৭ ডিসেম্বর ২০২৩

প্রতিটি জলবায়ু আসরের মতোই দুবাই সম্মেলনও শুরু হয় দুর্দান্ত আশা নিয়ে। কিন্তু নিদারুণভাবে আবারও ‘হতাশা' ছড়িয়েই শেষ হয়। শুরু থেকেই এবারের সম্মেলন বিতর্ক ও সন্দেহ উসকে দেয়।

https://p.dw.com/p/4acf7
সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত ২৮তম জলবায়ু সম্মেলনে সভাপ্রধান ছিলেন সুলতান আল-জাবের। যিনি দেশটির জাতীয় তেল কোম্পানি অ্যাডনকের প্রধান নির্বাহী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত ২৮তম জলবায়ু সম্মেলনে সভাপ্রধান ছিলেন সুলতান আল-জাবের। যিনি দেশটির জাতীয় তেল কোম্পানি অ্যাডনকের প্রধান নির্বাহী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছবি: Kamran Jebreili/AP Photo/picture alliance

সম্মেলনের সভাপ্রধান ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় তেল কোম্পানি অ্যাডনকের প্রধান নির্বাহী সুলতান আল-জাবের।

তেল কোম্পানির প্রধান কীভাবে জীবাশ্ম-জ্বালানিমুক্ত ভবিষ্যত আহবান করবেন তা ছিল এক বিস্ময়কর বিষয়। তেল, গ্যাস, কয়লা এরকম জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমেই সবচে বেশি কার্বন নির্গমণ হয়। নিদারুণভাবে ক্ষতবিক্ষত জলবায়ু, টগবগ করে ফুটন্ত এই গ্রহ। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের উন্নয়ন-অর্থনীতি।

৩০ নভেম্বর থেকে ১৩ ডিসেম্বর এই সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে বসেছিল ২৮ তম জলবায়ু সম্মেলন, কপ-২৮। ২০০ টি দেশের ৮৫ হাজার প্রতিনিধি ১৩ দিনে তহবিল, অর্থায়ন, অভিযোজন, প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার বিষয়ে তর্ক, বাহাস ও আলাপ জারি রাখেন। কেবল শুরু থেকে নয়; বহুজাতিক কোম্পানি প্রতিনিধিদের বিশাল বহর পুরো সম্মেলনকেই সন্দেহ এবং তর্কের মরূদ্যানে ঠেলে দেয়। তারাই রাষ্ট্রপক্ষের মোট প্রতিনিধিদের ৩০ ভাগ।

তেল কোম্পানি, কয়লা কোম্পানি, মাংস কোম্পানি, বীজ কোম্পানি কিংবা রাসায়নিক বিষ কোম্পানির লবিস্টরা ‘বনোয়াট কুতর্ক' আর ‘মিথ্যা সমাধানের' বিজ্ঞাপন দিয়ে পৃথিবীর বাঁচা-মরার প্রশ্নের সম্মেলনের গতিকে অযথাই বিনষ্ট করে। প্রতিটি দিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপ্রাদ্য নির্ধারিত হলেও সেসব আলাপ ও আয়োজন বৈচিত্র্য এবং বহুত্ববাদী কন্ঠস্বরকে নিশ্চিত করেনি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির অগ্নিকুণ্ড উসকে রেখে কোনোভাবেই জলবায়ু পরিবর্তন রোধ সম্ভব নয়।

সমাপণী ভাষণে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নির্বাহী সম্পাদক সিমন স্টিয়েল বলেন, ‘‘...জীবাশ্ম-জ্বালানিমুক্ত বিশ্বের শেষের শুরু এই সম্মেলন''। দুবাই সম্মেলনের সর্বশেষ প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার পুরোপুরি অঙ্গীকার এই সম্মেলন না করতেও পারলেও এটা একটা প্রারম্ভিকা। রাষ্ট্র ও বাণিজ্যকে বিলম্ব না করে এই উদ্যোগকে সত্যিকারের অর্থনৈতিক ফলাফলে পরিণত করতে হবে। ২০২৫ সালের ভেতর রাষ্ট্রসমূহকে শক্তিশালী জলবায়ু কর্মপরিকল্পনার করতে হবে।

সম্মেলনের প্রথম দুই দিন ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে' ১৫৪ রাষ্ট্র ক্ষয়ক্ষতি তহবিল বিষয়ে ঐতিহাসিক অঙ্গীকার করে। ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি তহবিল ঘোষিত হয়। আজারবাইজানে পরবর্তী কপ-২৯ এবং ব্রাজিলে কপ-৩০ আয়োজনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষসমূহ সম্মত হন। দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেয়া নানা দেশের প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশের জনমানুষের জলবায়ু-অভিজ্ঞতার আয়নায় সম্মেলনের এক পাবলিক পাঠ হাজির করছে চলতি আলাপ।

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্থানীয় জাতের ধান

অভিযোজনই একমাত্র শেষ কথা নয়

বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের উজানী কী বাসুদেবপুর গ্রামের কৃষকেরা দীঘা ধানের খড় আর কচুরিপানা দিয়ে ধাপ বা ভেলা বানিয়ে শাকসব্জি চাষ করেন। ‘গাউতা' নামের এই ভাসমান চাষ চান্দারবিলসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশ প্রাচীন কৃষি অভিযোজন পদ্ধতি। দেশজুড়ে বরেন্দ্র, হাওর, উপকূল, চর, পাহাড় কী নদী সমতলে বহু জলবায়ু অভিযোজনের নজির আছে গ্রামীণ সমাজে। বাংলাদেশের জলবায়ুগত অভিযোজন কৌশল আজ বৈশ্বিক আলাপের অংশ। বাংলাদেশের ভাসমান কৃষিঅঞ্চলকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব কৃষি ঐতিহ্য' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের' আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে ঢাকায়। কেবল বাংলাদেশ নয়; বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত নানামুখী অভিযোজন চর্চা।

দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেয়া ‘এশিয়ান ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের' প্রতিনিধি এস্থার পিনুনিয়া আলাপকালে জানান, ‘‘...একক বাণিজ্যিক ফসল এবং রাসায়নিক কৃষি জলবায়ু অভিযোজন সহায়ক নয়, দেশি বৈচিত্র্যময় ফসল প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদ করাই সত্যিকারের অভিযোজন''। সম্মেলনে অংশ নেয়া পানামার এম্বেরা আদিবাসী প্রতিনিধি সারা ওমি এবং নিডিয়া পাচিকো জানান, ‘‘...জোয়ারের পানি বাড়ছে, বন্যা বাড়ছে, টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত নানা কলাকৌশল বের করতে হচ্ছে, নারীরা এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছেন''।

ইকুয়েডরের ‘পরিবেশ, পানি ও প্রতিবেশগত রূপান্তর' বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ‘গ্লোবাল গোল অন অ্যাডাপটেশনের' সদস্য কারিনা বারেরা এক সহ-অধিবেশনে বৈশ্বিক অভিযোজন লক্ষ্যপূরণে স্থানীয় অভিযোজন চর্চাসমূহের স্বীকৃতির গুরুত্ব তুলে ধরেন। ‘সুইস ফেডারেল অফিস ফর দ্য এনভায়রনমেন্ট' প্রতিনিধি এবং বিজ্ঞানী রোল্যান্ড হফম্যান বলেন, ‘‘...লোকায়ত জ্ঞানই অভিযোজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে মানুষের অংশীদারিত্ব থাকে''। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ফিজির রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি দীপিতিকা চাঁন্দ সম্মেলনে আরেক সহ-অধিবেশনে জানান, ‘‘...পাঁচটি মৌলিক লক্ষ্য নিয়ে ফিজি তার কৃষিব্যবস্থাকে পরিচালিত করছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে প্রাধান্য, স্থানীয় শস্যবৈচিত্র্য সুরক্ষা, নিরাপদ কৃষি, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং জেন্ডার সাম্য।

ঘূর্ণিঝড় এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধি যেভাবে প্রতিনিয়ত আমাদেরকে ঝুঁকিতে ফেলছে সেখানে কৃষিব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য স্থানীয় জাতের শস্য ও বীজ সুরক্ষা করা জরুরি। এনডিসি প্রতিবেদনেও কৃষির অবদানকে যুক্ত করা জরুরি''। ‘ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ' এবং ‘অয়েলওয়াচ ইন্টারন্যাশনালের' নাইজেরিয়া প্রতিনিধি কেন্টেবে ইবিয়ারিডর এবং ভারত থেকে আসা ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ' এর গবেষক ডরোথি আস্মিতা বিশ্বাস আলাপচারিতায় উভয়েই জানান, ‘‘জলবায়ু অভিযোজন' গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অভিযোজনের চাইতে প্রশমন প্রক্রিয়াকে বেশি ত্বরান্বিত করা দরকার।''

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) ২০২৩ সালে ‘দ্য এডাপটেশন গ্যাপ রিপোর্ট' প্রকাশ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও ক্ষতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে প্রতিবেদনটি। প্রতিবেদন অনুযায়ী জলবায়ু-দুর্গত রাষ্ট্রসমূহের ক্ষেত্রে প্রতি দেশের জন্য বাৎসরিক প্রায় ২১৫ থেকে ৩৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি (২০১৫) অনুযায়ী, 'বৈশ্বিক অভিযোজন লক্ষ্যমাত্রা (গ্লোবাল গোল অন ক্লাইমেট এডাপটেশন/জিজিএ) এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার।

গ্লাসগো সম্মেলনে (কপ-২৬) সিদ্ধান্ত হয়েছিল দুবাই সম্মেলনে এই লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত হবে। দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক লক্ষ্য কিংবা স্থানীয় স্বীকৃতি, তহবিল, দক্ষতাবৃদ্ধি, অর্থায়ন বিষয়ে কোনো বিশেষ উদাহরণ তৈরি হয়নি। সম্মেলনে রাষ্ট্রপক্ষসমূহ বৈশ্বিক অভিযোজন লক্ষ্যমাত্রা (জিজিএ) সমর্থন করে এবং লক্ষ্য অর্জনে রাষ্ট্রসমূহের অভিযোজনের ক্ষেত্রে অর্থায়ন, প্রযুক্তি এবং দক্ষতা বৃদ্ধি সহযোগিতার ওপর জোর দেয়। জলবায়ু অভিযোজন তহবিলের ক্ষেত্রে ১৮৮ মিলিয়ন ডলার তহবিল অঙ্গীকার করা হয়। সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশের জন্য একটি নতুন তহবিল এবং বিশেষ জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল ঘোষণা করে ১৭৪ মিলিয়ন ডলার অঙ্গীকার করা হয়।

সাতক্ষীরায় সুপেয় পানির অভাবে বিপন্ন শিশুদের শিক্ষাজীবন

জলবায়ুজনিত সংকট মোকাবেলায় স্থানীয় অভিযোজন কৌশল এবং চর্চার স্বীকৃতি ও সুরক্ষা জরুরি। কেবলমাত্র তহবিল কোনোভাবেই অভিযোজনের লক্ষ্যকে অর্জন করতে পারে না। এর জন্য সামাজিক, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ন্যায্যতা সুরক্ষিত হতে হবে। জীবাশ্ম-জ্বালানির বাণিজ্য চাঙ্গা রেখে, কার্বণ নি:সরণের ভোগবিলাসিতা জিইয়ে রেখে জলবায়ু-দুর্গত গরিব মানুষের জন্য ‘কেবলমাত্র অভিযোজন' এবং ‘টিকে থাকার কৌশল' কোনোভাবেই ন্যায্যতা নিশ্চিত করে না। বিশ্বময় জেগে থাকা অভিযোজনের গল্পগুলি একইসাথে আমাদেরকে প্রশমন এবং প্রতিশ্রæতি পূরণে দায়বদ্ধ করে।

খাদ্যব্যবস্থার আলাপ জমিন থেকে টেবিলে

একবার এক কার্তিকের শেষে বাংলাদেশের দিনাজপুরের বিরলের ঝিনাইকুড়ি-হালজায় গ্রামে মনোসরি কড়া ও কলু কড়াদের সাথে ঘুরে ঘুরে শুনশুনি শাক ও গুঞ্জরি শামুক জোগাড় করছিলাম। কড়া আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘শুনশুনিয়া খিচড়ি' রান্নার কথা ছিল সেই দুপুরে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির দখল করা হাইব্রিড ভুট্টার জমিনে দশ জনের খাওয়ার মত শাক ও শামুক আমরা খুঁজে পাইনি। জার্মানীর বায়ার কোম্পানির ‘আগাছানাশক সানরাইস' কিংবা ভুট্টা বীজ ‘ডেকাল্ব' এর মতো সুইজারল্যান্ডের সিনজেনটা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মনস্যান্টো কোম্পানির বিষ এবং বীজের প্যাকেট জমির আইলে পড়ে থাকতে দেখি। সানরাইসের বিজ্ঞাপনে ‘শুনশুনিয়া শাককে' আগাছা হিসেবে প্রচার করা হয়।

‘হাইব্রিড ভুট্টা' উৎপাদনের জন্য, আগাছানাশক বিষ দিয়ে ভ‚ট্টা বাদে কৃষিজমির আর সব খাদ্য ও ভেষজ গাছ মেরে ফেলা হয়। মনোসরিরা জানিয়েছিলেন, সেইসব হাইব্রিড ভ‚ট্টা নাকি মানুষ খায় না, জমিতে প্রচুর বিষ ও সার দেয়ার কারণে শামুক, কেঁচো ও ছোট মাছ মরে যায়। কড়া জনগোষ্ঠী একসময় দেশি ভূট্টা জনরা, মেরূয়া, ঘাঙরা ফসল চাষ করতেন। দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে বায়ার কোম্পানির মতো বহুজাতিক লবিস্টদের ভিড়ে নিজ খাদ্য হারানো বাংলাদেশের এক দিনমজুর মনোসরির বিমর্ষ চেহারা সামনে ভেসে ওঠে। কড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ১০০ জন। এই মাত্র ১০০ জন গরিব মানুষের শুনশুনিয়া শাক কিংবা শামুক মেরে না ফেললে কী হয়? মনে পড়ে, হাইব্রিড ভুট্টা ‘ডেকাল্ব ৯২১৭' বিজ্ঞাপন দেয়, ‘ঝড়ের বিরুদ্ধে অসাধারণ দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা'।

এসব বহুজাতিক কোম্পানির ‘ঝড়' এবং ‘ক্ষমতা' আমাদের সামনে নয়াউদারবাদী বাস্তবতা হাজির করে। বহুজাতিক কোম্পানিদের এসব মিথ্যা সাফাই ও বিজ্ঞাপন বারবার ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপি প্রতারিত কৃষক ও সচেতন ভোক্তা আজ বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। দুবাই জলবায়ু সম্মেলনেও বহুজাতিক বাহাদুরির বিরুদ্ধে প্রবল আওয়াজ জারি ছিল। বুঝতে পেরেছি ‘ডেকাল্ব' হাইব্রিড বীজের বিজ্ঞাপনের ‘ঝড়' মানে ‘জনগণের প্রতিবাদ', আর ‘দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা' মানে হলো ‘মিথ্যা সমাধান প্যাকেজ'।

‘ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের' অঙ্গীকার দুবাই জলবায়ু সম্মেলনের এক উল্লেখযোগ্য অর্জন। আমার বিশ্লেষণ, খাদ্যব্যবস্থার আলাপকে জলবায়ু দরবারে টেনে আনা এই সম্মেলনের সবচে' গুরুত্ববহ দিক। সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহেই খাদ্যব্যবস্থা রূপান্তর বিষয়ে ঘোষণাপত্র তৈরি হয়েছে। ‘স্থায়িত্বশীল কৃষি, সক্ষম খাদ্যব্যবস্থা এবং জলবায়ু কর্মতৎপরতা' বিষয়ক ঘোষণাপত্রটিতে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশসহ ১৩৪ টি রাষ্ট্র। ‘জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) প্রতিবেদনে' এখন থেকে খাদ্য ও কৃষির বিবরণকেও যুক্ত করতে হবে। সম্মেলনের দ্বিতীয় সপ্তাহে ব্রাজিল, নরওয়ে, সিয়েরালিওন, কম্বোডিয়া এবং রুয়ান্ডা মিলে পুষ্টিকর, সহজলভ্য এবং টেকসই খাদ্যব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ‘অ্যালায়েন্স অব চ্যাম্পিয়ন ফর ফুড সিস্টেমস ট্রান্সফরমেশন (এসিএফ)' গঠন করে।

বাংলাদেশ উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততা উসকে দিচ্ছে বর্ণবাদ

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থার মতে, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন খাত হলো বৈশি^ক গ্রীণহাউস গ্যাসের নি:সরণের দিক থেকে তৃতীয়। মূলত রাসায়নিক কৃষি ও বহুজাতিক কোম্পানি নির্ভর খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা এই নি:সরণ ও দূষণ চাঙ্গা রাখে। কৃষক, জেলে, আদিবাসীসহ গ্রামীণ জনগণের লোকায়ত খাদ্যব্যবস্থা প্রকৃতিঘনিষ্ঠ। কিন্তু বিপদজনক খাদ্যব্যবস্থার বাহাদুরেরা দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে তাদের বহু লবিস্ট নিয়োগ করেছেন। তারা বিভিন্ন বিষ কোম্পানি, মাংস কোম্পানি আর খাদ্য কোম্পানি থেকে এসেছেন। ঠিক যেন ষাটের দশকে ‘সবুজবিপ্লব' চাপিয়ে দেয়ার মতো একই ঘটনা। বিশ^ব্যাংক, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, দাতাসংস্থা, কোম্পানি, সিজিআইএআর, বিজ্ঞানী নানাভাবে সবাইকে যুক্ত করে ‘জলবায়ু সংকট সমাধানের' নামে ওপর থেকে চাপানো আরেক মিথ্যা ‘ন্যারেটিভ' দাঁড় করানোর চেষ্টা।

সম্মেলনের দ্বিতীয় সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘জলবায়ুবান্ধব কৃষি'র' জন্য নতুন করে প্রায় ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এক তহবিল অঙ্গীকার করে। মূলত ২০২১ সালে গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৬) ‘দ্য এগ্রিকালচার ইনোভেশন মিশন ফর ক্লাইমেট' গঠনের ভেতর দিয়ে এই তহবিল অঙ্গীকার করে রাষ্ট্রপক্ষ, বহুজাতিক কোম্পানি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ২০২১ সালে প্রায় ৮০টি কৃষিপ্রকল্প গৃহীত হয়। গ্লাসগো সম্মেলনে ১৩ বিলিয়ন, মিশর সম্মেলনে ৮ বিলিয়ন এবং দুবাই সম্মেলনে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অঙ্গীকার হয়েছে।

যদি দুবাই সম্মেলনের ১৭ বিলিয়নের ভেতর ৫ বিলিয়ন বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি ও বেসরকারি দাতা সংস্থাদের। নতুন এই ১৭ বিলিয়নের জন্য ৫০০ থেকে ১,৫০০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ২৭টি কৃষিপ্রকল্পও দুবাই সম্মেলনে ঘোষিত হয়েছে। বাঞ্জ, গোগল, দ্য নেচার কনজারভেন্সি, ব্রাজিলের প্যারা রাজ্য পার্টনার হিসেবে থাকছে। রিজেনারেটিভ কৃষি উৎসাহিত করতে এইসব প্রকল্প কাজ করবে বলে আলোচনা হয়েছে। ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন' এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত যৌথভাবে কৃষি

ইনোভেশনের জন্য ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আরেকটি তহবিল অঙ্গীকার করেছে। সাব-সাহারা আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র কৃষকদের কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে এই তহবিল অঙ্গীকার করা হয়। তবে এই তহবিল মূলত ‘কসসালটেটিভ গ্রæপ অন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ (সিজিআইএআর)' কনসোর্টিয়াম এবং ‘অ্যাগ্রিকালচার ইনোভেশন মিশন ফর ক্লাইমেট (এআইএম-৪)' এদের মাধ্যমে ব্যয় হবে। এআইএম-৪ মূলত নি¤œ ও মধ্যআয়ের দেশের ক্ষুদ্রকৃষক, মিথেন হ্রাসকরণ, প্রযুক্তি ও কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা গবেষণা নিয়ে কাজ করে।

কৃষিভিত্তিক কোনো প্রকল্পে সিজিআইএআর বা বৃহৎ ফাউন্ডেশন জড়িত থাকলে আমাদের সামনে সবুজবিপ্লবের দুঃসহ নির্দয় স্মৃতি হাজির হয়। গ্রামের পর গ্রাম প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হারানোর রক্তদাগ আমাদের বাস্তুতন্ত্র ও শরীরে লেগে আছে। এসব প্রশ্নের উত্তর হাজির না করে কোনোভাবেই জলবায়ু ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাপি মূল খাদ্য উৎপাদক নিম্নবর্গের কৃষকের আহাজারি, বঞ্চনা এবং অনুশীলনগুলো শুনতে চায়নি দুবাই জলবায়ু সম্মেলন। খাদ্যব্যবস্থা রূপান্তরের আলাপকে বিশ্বব্যাপি পাবলিক আলাপ ও তৎপরতায় রূপ দিতে হবে। কোনো কোম্পানি, বহুজাতিক, শর্ত, ঋণ বা এজেন্সি নয়; প্রকৃতি ও সংস্কৃতির যৌথতায় জনমানুষের চর্চার ভেতর দিয়ে রূপান্তর ঘটবে ভবিষ্যত খাদ্যব্যবস্থার।

যুদ্ধ, সহিংসতা আর বারুদ থামাবে কে?

দুবাই সম্মেলন চলাকালীন কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় বন্যা ও ভূমিধস, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশে ভূমিকম্প এবং ভারতে ঘূর্ণিঝড় আঘাতের খবর আসে। কেবল ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা, ভ‚মিকম্প, লবণাক্ততা, ধস বা বজ্রপাত নয়; মানুষ মরছে অধিকারের দাবিতেও। যুদ্ধ কী সহিংসতায়। পৃথিবী জুড়ে জারি থাকা যুদ্ধ, অস্ত্রবাণিজ্য ও গণহত্যা না থামালে জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে না। দুবাই সম্মেলনে ফিলিস্তিনসহ সর্বত্র যুদ্ধ ও গণহত্যা বন্ধ করে জলবায়ু তৎপরতাকে ‘বেসামরিকীকরণ' করার আওয়াজ ওঠেছে।

‘হোয়াই ইস মিলিটারাইজেশন ওয়ান অব দ্য কি অবস্টাকল টু মিটিগেটিং ক্লাইমেট ক্রাইসিস', ‘গ্রাসরুটস ফেমিনিস্ট পারস্পেকটিভস অন ডিমিলিটারাইজেশন ফর ক্লাইমেট জাস্টিস' শিরোনামের সহ-অধিবেশন, আলোচনা কিংবা প্রতিবাদী কর্মসূচিগুলো যুদ্ধে বিনিয়োগ বন্ধ করে ‘জলবায়ু অর্থায়ন' নিশ্চিতকরণের দাবি ওঠেছে। ইউক্রেন প্যাভিলিয়নে শিল্পী ইয়ারোসালভা গ্রেস যুদ্ধবিধ্বস্ত শস্য ও উপকরণ দিয়ে এক চিত্রকর্ম তৈরি করেছেন। বোমার আগুনে পোড়া ভুট্টা, গাছের বাকল, মাটি থেকে যুদ্ধের আওয়াজ ভেসে আসে। কী নিদারুণ! পুড়ে যাওয়া এইসব শস্যদানা কিংবা মাটির ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে নিরূপিত হতে পারে? ফিলিস্তিন রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধি আলা কানান বললেন, যুদ্ধের ভেতর ঝুঁকি নিয়ে জলবায়ু সম্মেলনে আসার গল্প৷

বৈচিত্র্য, বহুত্ববাদ এবং বিশ্বায়িত বিচ্ছিন্নতা

ধানের নামে গ্রাম, নাকি গ্রামের নামে ধান? বাংলাদেশের হবিগঞ্জে গভীর পানির এক ধানের নাম লাখাই, পঞ্চগড়ের স্বল্পপানি নির্ভর এক ধানের নাম নেনিয়া। এই ধানের নামে দুটি এলাকাতেই লাখাই ও নেনিয়াপাড়া নামে গ্রাম আছে। পঞ্চগড়ের আটোয়ারীর রাধানগর ইউনিয়নের নেনিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক নারীরা নেনিয়া চাল দিয়ে নুনহাঁস পিঠা বানান। বিশুদ্ধ সারি নির্বাচনের জন্য পাকা ধানের শিষ দিয়ে ‘মাছিয়া' নামের এক কারুশিল্প বানিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ২০১৫ সালে পুরো নেনিয়াপাড়া ঘুরে মাত্র আটটি বাড়িতে মাছিয়ার সন্ধান পাই। নতুন প্রজন্মের কেউ এটি বানাতে জানেন না।

কৃষকেরা জানান, অনাবৃষ্টি এবং খরাকাল দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে নেনিয়া ধান ঝলসে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঝর্ণা হারানোর আরেক আহাজারি দেখেছিলাম বান্দরবানের রোয়াংছড়ির তারাছা ইউনিয়নের অংতং খুমী পাড়ায়। খুমী প্রবীণেরা জানিয়েছিলেন, আর্দ্রতা ও শীতল ছায়াযুক্ত পরিবেশ কমে যাওয়ার কারণে তুপু, লেংখি, লাহিং, ঠিংলাফাই গাছ গুলো হারিয়ে যাচ্ছে।

আফ্রিকা, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ কী উত্তর আমেরিকার বহু প্রতিনিধি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিজ এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য হারানোর গল্প হাজির করেছেন দুবাই সম্মেলনে। ‘ফুড ফর ক্লাইমেট প্যাভিলিয়নে' আমাজন বনের সংকট নিয়ে তৈরি সিনেমা ‘উই আর গার্ডিয়ানস' প্রদর্শিত হয়। ছবিটিতে বনের বৈচিত্র্য বিনাশ ও বন সুরক্ষায় আমাজন বনের আদিবাসীদের অবদান ওঠে এসেছে। প্রাণ, প্রকৃতি, প্রতিবেশ সুরক্ষা প্রশ্নে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি দুবাই সম্মেলনে।

কেবল প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য নয়, সামাজিক বহুত্ববাদের কার্যকর অন্তর্ভূক্তি খুব সক্রিয় ছিল না দুবাই সম্মেলনে। জলবায়ু সংকট জেন্ডার সহিসংতা বাড়ায় এমন আলাপ খুব একটা তুলেনি সম্মেলনের বিদ্যায়তন কী নাগরিকমঞ্চ। সম্মেলনে জেন্ডার সংবেদনশীল ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রশ্নে ৬৮টি দেশ এক ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক জোট আইইউসিএনের ‘রেজিলিয়েন্ট, ইনক্লুসিভ অ্যান্ড সাসটেইনবেল এনভায়রনমেন্টস (রাইজ)' গ্র্যান্টের জন্য নরওয়ে সরকারের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা নোরাড ২.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান ঘোষণা করে দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে। বলা হচ্ছে, পরিবেশগত সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জটিল হওয়া জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা রোধে নারীদের সুরক্ষার জন্য পৃথিবীতে প্রথম এই তহবিল ঘোষিত হয়েছে। নোরাডের জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ক পরিচালক পিয়ার ফ্রেডরিক ফারো জানান, ‘পরিবেশ ও জলবায়ু কর্মসূচির অধিকাংশ আলোচনায় জেন্ডার-সহিংসতা অনুপস্থিত থাকে'।

নিজস্ব সাংষ্কৃতিক সজ্জার কারণে কোনো কোনো আদিবাসী মানুষ দৃশ্যমান হলেও, একই দালানের ভেতর জ¦ালানিশক্তি এবং আদিবাসীদের প্যাভিলিয়ন আরেক জিজ্ঞাসা তৈরি করে। শিশু, প্রবীণ, পেশাজীবী, প্রতিবন্ধী মানুষ, ধর্মীয় নেতা কিংবা জলবায়ু-উদ্বাস্তুদের আওয়াজ খুব একটা দৃশ্যমান হয়নি। সম্মেলনে কথা হয় নেপালের উমেশ বালাল মাগানের সাথে। কাজ করেন ‘নেপাল ওয়াটার কনজারভেশন ফাউন্ডেশন' নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। ক্ষোভ আর বিষাদ নিয়ে বলেন, ‘‘...এর আগের অনেক কপে প্রতিবন্ধী মানুষদের কিছুটা স্পেস ছিল, দুবাইতে কিছুই নাই, এমনকি সবার জানাবোঝার মতো কারিগরি ব্যবস্থাপনা গুলো রাখা হয় নাই। প্রতিবন্ধী মানুষদের পেছনে রেখে কী সামনে আগানো সম্ভব?'' দুবাই সম্মেলনে আসা নানা দেশের মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে বহু মানুষের নির্দয় উপনিবেশিকতার স্মৃতি-বিস্মৃতি আছে। আজ নয়াউদারবাদী আরেক উপনিবেশিকতার বাজারে বন্দি মানুষ। একইসাথে মানুষ ক্রমান্বয়ে বড় বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি থেকে, বিশ্বায়িত এই বিচ্ছিন্নতাকে আরো বেশি উসকে দিচ্ছে জলবায়ুগত সংকটগুলো।

ভুলে যাওয়া দাগের কৈফিয়ত

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে জলবায়ু সম্মেলন হয়নি। করোনা মহামারির শেষের দিকে অনুষ্ঠিত গ্লাসগো ও মিশর সম্মেলনে মানুষজনের মুখে কিছু মাস্ক ছিল। কিন্ত দুবাই সম্মেলনে মুখে মাস্ক ছিলই না। কিন্তু এতো সহজেই কী মহামারির নিষ্ঠুর দাগ মুছে যাবে? বৈশ্বিক স্টকটেক অনুযায়ী তাপমাত্রার পারদ ১.৫ ডিগ্রির ভেতর রাখা কিংবা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস নিয়ে কোনো আশার আওয়াজ দিল না দুবাই। কেবল তহবিল আর জ্বালানি-বাণিজ্য নিয়ে কিছু তুলকালাম হল। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, দাতাসংস্থা, বেসরকারি সংস্থাসহ উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে সম্মেলনে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট প্ল্যাটফর্ম (বিসিডিপি)'।

একের পর এক দুর্যোগে মনোরোগে ভুগছেন সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ

ভবিষ্যতে অভিযোজন, প্রশমন এবং টেকসই চর্চা বাস্তবায়নে বেসরকারি বিনিয়োগ আশা করছে এই প্ল্যাটফরম। ২২ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী। ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু তহবিলের অঙ্গীকার আবারো স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। সম্মেলনে ৩৬টি দেশ মিলে নতুন এক ‘ক্লাইমেট ক্লাব' গঠন করে। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য মূলত শিল্পখাতকে কার্বনদূষণ মুক্ত করার ক্ষেত্রে কাজ করার অঙ্গীকার করে এই ‘জলবায়ু ক্লাব'।

দুবাই সম্মেলনে নতুনভাবে গঠিত এইসব প্ল্যাটফরম কিংবা ক্লাব জলবায়ু অঙ্গীকার পূরণে কতোটা সাহসী এবং দায়িত্বশীল হতে পারবে? জলবায়ু আহাজারি এবং সত্যিকারের সবুজ অনুশীলনগুলি নিরপেক্ষভাবে পাঠ ও আন্দাজের জন্য পরিসর তৈরি করতে হবে এসব মঞ্চকে। আশা করি নিজ দেশের বাস্তুতন্ত্র, জনগণ এবং প্রতিশ্রুত অঙ্গীকারের কাছে এই মঞ্চগুলি জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।

মহামারি, ক্ষমতা কী কাঠামোগত বৈষম্যের ক্ষত ও দাগকে স্বাক্ষী রেখে বিশ্বময় তারুণ্যের সৃজনশীল ভাষা এবং ভঙ্গিমার উচ্চারণ ছিল দুবাই সম্মেলনে। আইভরিকোস্ট থেকে চারটি রি-সাইকেল শিল্পকর্ম নিয়ে যোগ দেন শিল্পী ইবনে শেইখ সাল্লাহ ডিবেকিলে। ইথিওপিয়ার চিত্রশিল্পীদের জলবায়ু সুবিচারের একটি প্রদর্শনী ছিল তাদের প্যাভিলিয়নে।

তুর্কি শিল্পী আইসেগুল আকিউরেক তুরস্ক প্যাভিলিয়নে সবাইকে এক বিশেষ মাটি দিয়ে শিল্পকর্ম শিখিয়েছেন। ভারতীয় তরুণ শিল্পী শিলো শিব সুলেমান শাড়িকে পরিণত করেন দীর্ঘতম এক খুফিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের জেনেভাইভ ক্যাসামেন্টো কিংবা নাইজেরিয়ার লেখক ডিওরিমেনে কইকইবো এবং ওনম ইতিসিরো সম্মেলনে এনেছেন তাদের গল্পের বই। এইসব আওয়াজ জানান দেয়, তরুণ প্রজন্ম দাগ মনে রাখছে, দাগের কৈফিয়ত চাওয়ার সাহস জিইয়ে রাখছে।

আধা মাইল লম্বা বুর্জ খলিফা কিংবা পানির লাইন

দুবাইবাসীর জন্য জলবায়ু সম্মেলন এক নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। কারণ সম্মেলনকালীন ভোর থেকে রাত অবধি মেট্রো গুলো চলেছে। ইউনিয়ন নামের এক মেট্রোস্টেশনে ট্রেন বদল করে যখন ‘বানিয়াস স্কয়ারে' নামি, ভেবেছিলাম ভুল স্টেশনে নেমেছি। এখানে সব মানুষের চেহারা একইরকম। আর এই মানুষেরা আমার অতিপরিচিত। এই ঘিঞ্জি, এই ঘাম, এই চেহারা, এই দম না ফেলা জীবন আমার খুব পরিচিত। এই মেট্টো স্টেশনে এশিয়া আর আফ্রিকার ‘দেশ' হারিয়ে আসা মানুষের ভিড়। জলবায়ু সম্মেলনের মঞ্চে কী এই মানুষেরা কথা বলেছেন কোনোদিন? অথচ এই শ্রমিকদের অভিবাসী হওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটের নির্দয় গল্প আছে।

যাহোক দুবাইতে অবস্থিত আধা মাইল লম্বা দুনিয়ার সবচে উঁচু দালান বুর্জ খলিফার নির্মাতা এই অভিবাসী শ্রমিকেরাই। প্রতিদিন বিকাল হতে কৃত্রিম আলোর নাচন দেখতে ভিড় জমে এখানে। দিনে প্রতি ঘন্টায় নাকি আড়াই লাখ কিলো ওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয় বুর্জখলিফায়। জানি এই বিলাসিতার মর্ম পাঠ আমার কাজ নয়। দুবাইয়ের রাস্তায় ঝলমলে বুর্জ খলিফা নয়; আমার সামনে খালি কলস হাতে এসে দাঁড়ায় বাংলাদেশের উপকূল আর বরেন্দ্র অঞ্চলের আধা মাইল লম্বা পানির মিছিল।

কানাডা থেকে আগত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ‘অ্যাসোসিয়েশন কুইবেক্ইুজ দ্যস অর্গানাইসম ডি কুপারেশস ইন্টারন্যাশনালের' প্রতিনিধি ডেনিস কোটের সাথে আলাপকালে জানান, ‘‘...জলবায়ু সম্মেলনের সকল সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া আমরা কার্বণ নিঃসরণ কমাতে পারব না, জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারব না''। প্যারাগুয়ের রাষ্ট্রদূত ড. জুয়ান ফ্রান্সিসকো ফেচেট্টি বিশ্বব্যাপি প্রাণবৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষার জন্য জলবায়ুজনিত অপরাধসমূহ রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে সক্রিয় করে দমনের কথা বলেন

জার্মানি থেকে সম্মেলনে যোগ দেয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি ও ‘গ্রিন পার্টির' সদস্য রাজনীতিবিদ জুট্টা পাওলুসের সাথে দুবাই মেরিনা এলাকার এক হোটেলে নৈশভোজে ‘জলবায়ু তৎপরতা এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকার' বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়। জার্মানির ইউরোপ এবং জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী ড. আন্না ল্যুরমান এমপির নীতিপরামর্শ বিষয়ক কর্মকর্তা মারেকি ওয়েলও এই নৈশভোজে অংশ নেন। আর্জেন্টিনার রাজনীতিবিদ মারিয়া লাওরা ক্যাসটিলো ডিয়াজও এই নৈশভোজে উপস্থিত ছিলেন। জলবায়ু ন্যায়বিচারের আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক অঙ্গীকারের আন্দোলন' হিসেবে ব্যাখা করেন এই রাজনীতিবিদগণ। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভর পৃথিবীর উৎপাদন-অর্থনীতির ন্যায্য ও অর্ন্তভ‚ক্তিমূলক রূপান্তর সম্ভব। আজারবাইজান সম্মেলনের আগে আশা করবো বিশ্বনেতৃত্ব জলবায়ু প্রতিশ্রুতিকে রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন। বিমর্ষ চোখে তাকানো পৃথিবীর প্রতি নতজানু ও দায়িত্বশীল হবেন।

গবেষক ও লেখক