1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
সমান অধিকারবাংলাদেশ

পদে পদে দোষ ‘মেয়েমানুষ’ কবে মানুষের মর্যাদা পাবে

শামীমা নাসরিন
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

সমাজের টিপ্পনীকে পাশে রেখে যারা নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছেন তাদের জন্য কাপ জিততে চেয়েছেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় সানজিদা আক্তার৷ চেয়েছেন অনুজদের বন্ধুর পথ কিছুটা হলেও সহজ করে দিতে৷

https://p.dw.com/p/4HFzx
ঢাকার কাছে কাশবনে এক কিশোরী
শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে এখনও সমাজে প্রতিটি নারীকেই প্রতিনিয়ত ভোগান্তি সহ্য করতে হয়৷ছবি: Mohammad P. Hossain/Reuters

সাফ উইমেনস চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠার পর সানজিদা ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন৷ কাপ জিততে পেরেছেন সানজিদারা৷ প্রথমবারের মত নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাএসেছে বাংলাদেশে৷

কিন্তু সমাজের যে টিপ্পনীর কথা ওই মেয়েরা বলেছে বা যে বন্ধুর পথ আগামী দিনে কিছুটা সহজ হওয়ার  আশা তারা মনে লালন করছে তার কতটুকু পূরণ হবে?

শুধু এই মেয়েগুলোই যে বাধার পাহাড় ঠেলে খেলার মাঠে পৌঁছেছে তা তো নয়৷ বরং বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়েকে এগিয়ে যেতে এই বাধার পাহাড় ঠেলতে হয়৷ তা সে সমাজের যে স্তরের মানুষই হোক না কেনো৷

মেয়েদের প্রথম বাধা আসে তার নিজ পরিবার থেকেই৷ এই ২১ শতকে এসেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবার ছেলে সন্তানের আশা করে৷ প্রথমটি মেয়ে হলে তাও মানা যায়৷ তারপর একটা ছেলে চাই চাই৷ বংশ রক্ষা করতে হবে যে৷ যেন কোন রাজবংশ!

আমার পরিবারের কথাই বলি৷ আমরা পরপর চার বোন, আমি সবার বড়৷ একটি ছেলে সন্তানের জন্য ঈশ্বরের কাছে বাবা-মার আকুতি আমি নিজ চোখে দেখেছি৷ আশেপাশের লোকজন, বন্ধু-স্বজনেরা নিয়মিত বাবা-মা কে শোনাতো তাদের কোনো ছেলে নেই, তাদের কী হবে৷ ভবিষ্যতে কে তাদের দেখবে!

বাবার মৃত্যুর পর সমাজ আরো বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমি মেয়ে৷ তাই অনেক কিছু আমি করতে পারবো না! সেই অনেক কিছুর মধ্যে একটার গল্প বলি৷ বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের একটি জমিতে সীমানা প্রাচীর তুলতে গেলে আশেপাশের কিছু লোক বাধা দিলেন৷ বিরোধ মেটাতে দৃশ্যপটে হাজির হলেন স্থানীয় কমিশনার৷ আমাদের ডাকা হলে গেলাম আমি আর মা৷ তিনি দুই নারীকে দেখে মুখের উপর বলে দিলেন ‘মেয়েমানুষের’ সঙ্গে তিনি কথা বলবেন না, পুরুষ কাউকে ডাকুন৷

ততদিনে আমি স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি৷ তাই নিজেকে উচ্চশিক্ষিত বলে দাবি করতেই পারি৷ আমার মাও বিচক্ষণ মানুষ৷ কিন্তু যেহেতু আমরা ‘মানুষ নই মেয়েমানুষ মাত্র’ তাই তিনি আমাদের কথা বলার যোগ্যই মনে করেননি৷

আমরা তাকে বললাম, কথা বললে আমাদের সঙ্গেই বলতে হবে৷ কারণ, তখন আমাদের পরিবারে একমাত্র ‘পুরুষ’ আমার ছয় বছরের ভাই৷ কমিশনার সাহেব হুকুম জারি করলেন চাচাদের কাউকে ডাকুন৷ আমরা জেদ ধরে বসে থাকলাম, জমি যেহেতু আমাদের৷ কথা বললে আমাদের সঙ্গেই বলতে হবে৷ এই জেদের কারণে কম ভুগতে হয়নি৷ দুই বছর রীতিমত যুদ্ধ করে ওই জমিতে সীমানা প্রাচীর দিতে পেরেছি৷

শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে এই ধরনের ভোগান্তি প্রতিটি নারীকেই প্রতিনিয়ত সহ্য করতে হয়৷

পরিবারে, সমাজে, রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে, কর্মক্ষেত্রে নারীকে প্রতিনিয়ত হেনস্তা হতে হয়, অপমানিত হতে হয়, যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়, লড়াই করতে হয়৷ এই লড়াইয়ে জিতে, বাধার পাহাড় ঠেলে খুব কম নারীই পারেন নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে৷ যেমনটা পেরেছেন সাবিনা-কৃষ্ণা-মণিকা-মারিয়া-সানজিদারা৷

যেমনটা পেরেছে বিউটি খাতুন৷ আমাদের গ্রামেরই মেয়ে৷ ওর এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন আমরা গ্রামের বাড়িতে ছিলাম৷ ওর বাবা ওকে আর মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে আমার মাকে সালাম করতে আসে৷ বলে, ভাবি অনেক পড়ছে এবার বিউটির জন্য একটা ভালো ছেলে খুঁজে দেন৷ বিয়ে দিব৷ আম্মা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, কেনো বিয়ে দেবে? আরেকটু পড়ুক৷ বিউটির আরো দুইভাই লেখাপড়া করে৷ তিনজনের পড়ার খরচ ওর বাবার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়৷ তাই মেয়ের লেখাপড়ার ইতি টানার সিদ্ধান্ত৷ অথচ দুই ভাইয়ের তুলনায় বিউটির লেখাপড়ায় আগ্রহ বেশি৷

ওই রাতে বিউটি আবার এসেছিল আমাদের বাড়িতে৷ কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে বলেছিল, আব্বাকে একটু বলেন৷ আমি পড়তে চাই৷

বিউটি খাতুন
বিউটি খাতুনছবি: Private

পড়তে গিয়ে ওকে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে৷ আম্মা ওকে আমাদের শহরের বাসায় নিয়ে যায়৷ নিজের পড়ার খরচ নিজেই যোগাড়ের চেষ্টায় টিউশনি করেছে, ছোটখাটো কাজ করেছে৷ থাকা-খাওয়া দেয়া ছাড়া আম্মা খুব একটা সাহায্য করতে পারেন নাই৷ তার মেয়েরাই তখন পড়ছে৷

বিউটির বাবা বেশ কয়েকবার এসেছিল ওকে নিয়ে যেতে৷ ও যায় নাই৷ এইচএসসির পর ঢাকায় পড়তে চায়৷ কিন্তু কেউ সাহায্য করেনি৷ নিজেই পত্রিকা ঘেঁটে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিনাপয়সায় ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারিতে পড়ার ব্যবস্থা করে৷ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছিল৷ আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী সবার টিপ্পনি উপেক্ষা করে ও ঢাকায় চলে যায়৷ তিন বছরের কোর্স শেষ করে নিজের চেষ্টায় চাকরি যোগাড় করে৷ চাকরি করতে একাই চলে যায় কক্সবাজার৷ এখন বিউটি সরকারি চাকরি করে৷ মিডওয়াইফ পোস্টে চাকরিও পেয়েছে নিজের যোগ্যতাতেই৷ নিজের চাকরির টাকায় বাবাকে পাকাবাড়ি বানাতে অনেকখানি সাহায্য করেছে৷ বিয়ে করেছে, সন্তান হয়েছে৷ গ্রামের সবাই এখন বিউটিকে ভালোবাসে৷

ওর ছেলেকে দেখতে গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে৷ আনন্দে ঝলমল করছে ওর মুখ৷ বলেছে, ‘‘আপা খুব ভালো আছি৷ যদি আমার মেয়ে হয় ওকে আমার মত কষ্ট করতে দেব না৷’’

বিউটি চাইলেই কী ওর মেয়ের বেড়ে ওঠার পথ প্রতিবন্ধকতা মুক্ত করতে পারবে? সমাজ কী সেটা হতে দেব? আমরা কী সেটা হতে দেব?

সাফ জয়ী জাতীয় নারী ফুটবল দলের আটজনই ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার অজপাড়া কলসিন্দুর এর মেয়ে৷ ওরা যখন খুব ছোট তখন কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিনের হাত ধরে ওরা মাঠে নেমেছিল৷ তাদের মাঠে আনার গল্প করতে গিয়ে এই শিক্ষক বলেন, ওদের তখন হাফপ্যান্ট পরার বয়স৷ তারপরও পরিবার থেকে খেলতে দিতে চায়নি৷ গ্রামের লোকজনও অনেক কটু কথা বলেছে৷ অনুশীলনের পর ওদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল না৷

মেয়ে ফুটবল খেললে পুরো পরিবার দোজখে যাবে বলে দিনের পর দিন ভয় দেখানো হয়েছে জাতীয় দলের স্ট্রাইকার রংপুরের মেয়ে সিরাত জাহান স্বপ্নার পরিবারকে৷

এখন সবাই ওদের প্রশংসা করছে৷ কলসিন্দুর আরো অনেক মেয়ে এখন ফুটবল খেলছে৷ পরিবার থেকেও আগের মত বাধা নেই৷ কিন্তু কলসিন্দুর বাইরের বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনো বলতে গেলে আগের মতই আছে৷ গ্রামে এখনো কিশোরী মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দিতে চেষ্টা করে বেশিরভাগ পরিবার৷

শামীমা নাসরিন, সাংবাদিক
শামীমা নাসরিন, সাংবাদিকছবি: privat

শহরে যদিও পরিস্থিতি খানিকটা পাল্টেছে৷ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে মেয়েরা এখন ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীদের অংশগ্রহণ এখনো খুবই নগণ্য৷ এখনো ভাবা হয় বিয়ে নারীর জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য৷ বিয়ের পর সে সংসার ও সন্তান পালনে অধিক মনযোগ দেবে৷ তাই বিয়ের আগে অনেক নারী চাকরি বা ব্যবসা করলেও বিয়ের পর দুইদিক সামাল দিতে না পেরে নারীকে ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয়৷ যে অল্প কয়েকজন দুইদিকে ভারসাম্য রেখে চলতে চান, তাদেরও প্রতিনিয়ত শুনতে হয় কটু কথা৷ পরিবার থেকে বলে, তুমি ঠিকমত সংসার করছো না৷ সন্তানদের সময় দিচ্ছো না৷ ওদিকে, কর্মক্ষেত্র থেকেও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়৷ সব দায় যেন একা নারীর৷

গৃহিনী নারীদের তো আরো কষ্ট৷ উদয়-অস্ত পরিশ্রম করেও তাদের কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই৷ বরং শুনতে হয়, ‘কী কাজ করো সারাদিন'৷ আর্থিক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিচ্ছু নেই৷ হাসি হাসি মুখের আড়ালে সব গৃহিনীর গল্প প্রায় একই৷

নারী কর্মজীবী হোক বা গৃহিনী তার পথ নানা প্রতিবন্ধকতায় ঠাসা৷ প্রতিনিয়ত তাকে ভুগতে হয় নিরাপত্তাহীনতায়৷ পরিবারে, রাস্তাঘাটে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই তাকে পথ চলতে হয়৷

পরিবার ও সমাজে তথাকথিত শান্তি বজায় রাখতে তাদেরই ছাড় দিতে হয়৷ পিছিয়ে যেতে হয়, থেমে যেতে হয়৷

এই ছাড় না দিয়ে, পিছিয়ে না গিয়ে, থেমে না গিয়ে যে অল্প কজন সাহসী নারী লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন তাদের জানাই স্যালুট৷ আর যারা তা পারেনি তাদের জন্যও স্যালুট, তারা লড়ে গেছেন৷ এভাবে হারতে হারতেই একদিন নারী সব বাধা পেরিয়ে জিতে যাবে৷