1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বেস্ট সেলারের তালিকা আর তরুণদের হাততালি

মোস্তফা মামুন
১৬ এপ্রিল ২০২১

কয়েক বছর আগে বই মেলা শেষে কিছু লেখক-প্রকাশকের একটা আড্ডা হচ্ছে। মেলা শেষে সবাই নিজের মতো একটা অঙ্ক মেলায়। তাৎক্ষণিক সেই অঙ্কে পরের বছরের মেলার কিছু ভাবনাও থাকে।

https://p.dw.com/p/3s86F
Bangladesch, Dhaka | Amar Ekushey Buchmesse 2021
ছবি: Mortuza Rashed/DW

তো সেই আড্ডায় প্রকাশকরা চেনা লেখকদের কাছে ‘আগামী বার এরকম কিছু করেন...', ‘ওরকম একটা জিনিস সামনের বইমেলায় চাই...' এরকম দাবি জানাচ্ছেন।

একজন প্রকাশক এর মধ্যে চুপ করে বসে।

লেখকদের মধ্যে জনপ্রিয় ঘরানার একজনও ছিলেন, যার বই আগাম নেয়ার জন্য প্রকাশকদের বেশ আগ্রহ থাকে। তিনি সেই নিস্পৃহ প্রকাশককে বললেন, ‘‘কি. আপনার বই লাগবে না?''

প্রকাশক জিভ কেটে বললেন, ‘‘আপনারা বড় লেখক। যেখানে-সেখানে বই চাইলে হবে নাকি? সময়মতো যাবো।''

কিন্তু তার এই বিনয়ের মধ্যে কোথাও যেন একটা এড়িয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার ছিল। পরিচিত আরেক প্রকাশক পরদিন নিশ্চিত করলেন, ‘‘ও তো বলে ওর আর লেখক লাগবে না।''

‘‘লেখক লাগবে না? প্রকাশনা ছেড়ে দিচ্ছে নাকি?''

‘‘আরে না না, ওর লেখক লাগবে না বলেছে। বই লাগবে না, তা তো বলেনি।''

‘‘লেখক না হলে বই পাবে কোথায়?''

‘‘লেখক বানাবে।''

সত্যিই লেখক বানালো। কয়েক বছরের মধ্যে অবস্থা এমন যে, বইমেলা চলার সময় সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে যে কয়েকটি স্টলে, তার মধ্যে এই প্রকাশকের স্টলটিও পড়ে। সেলিব্রিটিদের উপচে পড়া ভিড় ভেতরে। বাইরে সেল্ফিবাজদের। মাঝেমধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ডাকতে হয়। বইমেলায় বা সারা বছরের বই বিক্রির তালিকায় তার সেসব বানানো লেখকরাই শীর্ষে থাকেন।

লেখক বানানোর প্রক্রিয়াটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। বিভিন্ন লাইনের সেলিব্রেটিদের ধরলেন তিনি। তা যেসব সেলিব্রেটি লিখতে জানেন, বা যাদের লেখা ‘যোগ্য' বলে অন্যরা মনে করেছেন, তাদের কেউ লেখার বাকি নেই। তিনি গেলেন সেইসব মানুষদের কাছে, যারা লেখালেখি থেকে হাজার মাইল দূরে। এখনকার এসব সেলিব্রেটি বা মাটি ফুঁড়ে বেরোনো মোটিভেশনাল স্পিকাররা দুনিয়ার কোনো কাজকেই নিজেদের অসাধ্য বলে মনে করেন না। কলম খুলে লিখলেন, অথবা প্রাণ উজাড় করে বললেন। বই হয়ে গেল। আর প্রেরণার খোঁজে ছুটে বেড়ানো একদল প্রেরণাহীন তো আছেই। এতএব দুয়ে দুয়ে চার মিলে মেলার মাঠে ওদের ভিড়ে অন্যদের দাঁড়ানোই দায়।

এভাবে একরকমের বইয়ের বাজার তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে সমান্তরালভাবে আছে ইসলামী বা ধর্মবিষয়ক বইয়ের বাজার। ওয়াজে ‘ঠিক কিনা বলেন' হুজুরের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে জীবনপাত করে ফেলা মানুষের সারিকে আমরা দেখি, দেখি ইউটিউবে হাস্যকর-অবৈজ্ঞানিক-অযৌক্তিক-নারীবিরোধী-সাম্প্রদায়িক উস্কানির লাখ লাখ ভিউয়ার। এই বিরাট বাজারকে ব্যবহারের লোভে এই ক্ষেত্রেও প্রচুর বই বেরোচ্ছে। এবং এগুলোও তালিকার উপরের দিকে।

আছে স্পোকেন ইংলিশ, সহজে চাকরি পাওয়া, বিদেশে ভিসা পাওয়ার গ্যারান্টি জাতীয় বইয়েরও তুমুল চাহিদা। এসব মিলেই তৈরি হচ্ছে বেস্ট সেলার তালিকা, যা দেখে মাঝে মধ্যে শিউরে ওঠেন কেউ কেউ। গতবার যেমন, বেস্ট সেলারের দশ লেখকের নাম দেখে এক সহকর্মী বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘‘আমি কি অন্য দেশে থাকি নাকি? কাউকেই তো চিনি না।'' এবারও রকমারির তালিকায় সবার উপরে স্পোকেন ইংলিশের একটা বই। বেস্ট সেলার লেখক হিসাবে সেই লেখককে দেখাচ্ছে স্বাভাবিক। এখন যদি, রকমারি ডটকম বা অনলাইনের দুনিয়া খুব না ঘাঁটা মানুষকে জিজ্ঞেস বলা হয় বাংলাদেশের এই সময়ের বেস্ট সেলার রাইটারের নাম অমুক, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই চিন্তা করতে শুরু করবেন, এর কোনো লেখা পড়েছেন কিনা৷ মনে করতে পারবেন না। সৃজনশীল সাহিত্য পড়া কেউ যার লেখা পড়েনি, তিনি বেস্ট সেলার লেখক!

মোস্তফা মামুন, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
মোস্তফা মামুন, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকছবি: MIRFARID

এখানে লেখকের দোষ নেই। দোষ বোধহয় কারো নয়। ব্যাপারটা বুঝতে হবে। আসলে ঠিক সেই অর্থে না হলেও ইসলামী বইয়ের বাজার সবসময়ই ছিল। ইংরেজি শিক্ষার বা এরকম প্রয়োজনীয় বইও বিক্রি হতো বিস্তর। কিন্তু এগুলোকে ঠিক সৃজনশীল-মননশীল বইয়ের সঙ্গে তালিকায় কেউ একীভূত করতো না। সত্যি বললে, রকমারি আসার আগে এসব তালিকার ব্যাপারই ছিল না। কাশেম বিন আবু বাকারের বই হাজার হাজার বিক্রি হয়েছে, সেই খবর কেউ রেখেছে? মূল ধারার গণমাধ্যম একরকম চেপেই গেছে, পাছে একে স্বীকৃতি দিয়ে ফেললে বইয়ের বিক্রি আরো বেড়ে যায়। তখন কিছু অপ্রিয় বা অপছন্দনীয় সত্যকে চাপা দিয়ে রাখা যেতো, এখন সেই ব্যবস্থা আর নেই। এমনও দেখেছি, বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাপার ক্ষেত্রে কোনো কোনো পত্রিকা বইটা আগে দেখে নিতে চাইতো। ফলে সাহিত্য-চর্চা বা বইয়ের ক্ষেত্রে একরকম প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আবার সেটাই বা ঠিক হয় কী করে? এরকম নিয়ন্ত্রণে তো সাহিত্যে গোষ্ঠীতন্ত্রও চালু হয়ে যেতো।

আরেকটা সমস্যাও আছে বোধহয়। রকমারির তালিকাটাকেই কেউ কেউ শেষ কথা ধরে নিচ্ছেন। এটা হচ্ছে পুরোটাই অনলাইন বিক্রির তালিকা। মনে রাখুন, অফলাইনেও প্রচুর বই বিক্রি হয়। জাফর ইকবালকে উদাহরণ ধরলে, তার বইয়ের বিক্রির সর্বোচ্চ এক চতুর্থাংশ বিক্রি হয় অনলাইন অর্ডার থেকে। আবার কারো ক্ষেত্রে হয়ত সেটা শতকরা ৭৫ ভাগ। কাজেই এই অনলাইন বিক্রি বা এই তালিকাই চূড়ান্ত সত্য নয়। অনলাইনে হাওয়া বেশি। আওয়াজ বেশি। তাছাড়া অনলাইন ব্যবহারকারী বেশিরভাগ হচ্ছে তরুণ, কাজেই তাদের পছন্দই এখানে প্রতিফলিত হবে। তরুণরা যেসব বই কিনেন, সেগুলো উপরে থাকবে। বয়স্কদের পছন্দেরটা পেছনে থাকবে। শিশু-কিশোরের পছন্দের বইয়ের সঠিক চিত্রও অনলাইনে আসবে না।

কেউ কেউ ইতিমধ্যে তাই রকমারিকে এই পরামর্শ দিচ্ছেন যে, সামগ্রিক তালিকা না করে ক্যাটাগরি ধরে আলাদা তালিকা করতে। এখানে সামগ্রিক তালিকাই বরং খণ্ডিত ছবি প্রকাশ করে। গল্প-উপন্যাস-কবিতার বিক্রি কোনোভাবেই ধর্মীয় বা শিক্ষামুলক বইয়ের কাছাকাছি যাবে না। কেউ কেউ বলবেন, বিক্রি নিয়ে অত কথা বলে লাভ কী, বিক্রি তো আর শেষ কথা না! বিক্রি শেষ কথা না বলেই সৃজনশীল-মননশীল বইকে বিক্রিতে আর দশটার সঙ্গে এক পাল্লায় না রাখাই ভালো। মনে রাখতে হবে, কম বিক্রির এসব বইয়ের পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। প্রবন্ধের বই না চললেও লিখতে হবে। একজনও যদি পড়ে, সেই একজন আলোকিত হবে। সেই একজন আরো দশজনকে আলোকিত করতে পারবে।

আমার সামগ্রিক দুশ্চিন্তা কিন্তু এই বেস্ট সেলার তালিকা নিয়ে নয়। এটা খানিকটা ফেসবুকের মতো। লোকে বলে, ফেসবুক আসায় সব উচ্ছন্নে যাচ্ছে। যার যা ইচ্ছা বলছে। কিন্তু ঘটনা হলো, যার যা ইচ্ছা আগেও বলতো। সেটা বলতো ঘরের ভেতরে, কিংবা মোড়ের চায়ের দোকানে। এই কথাকে কেউ অত গুরুত্বের সঙ্গে নিতো না। আমরা যেটা করি, ফেসবুকের যে-কোনো আওয়াজকে মানুষের ক্ষোভ বা আবেগের প্রকাশ না ধরে এটাকেই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সেই অনুযায়ী সমাজ-দেশ চালানোর চিন্তা করি। বেস্ট সেলারের তালিকাও সেরকম। এটা সবসময়ই এরকম ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে। এই যা!

তবে চিন্তার কথা অন্য। এসব বই কেন আমাদের তরুণরা পাগলের মতো কিনছে। ওদের জীবনে কেন এত হতাশা যে, অনুপ্রেরণার জন্য রংচং মাখানো কথার ফুলঝুরিতে আশ্রয় খুঁজতে হয়। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণদের একটা অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে গেলাম। দেখি, সেখানে আরো অনেক পরিচিত লোক থাকলেও একজন অল্পবয়সি কেতাদুরস্ত মানুষকে নিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজনা ছাত্র-ছাত্রীদের। খোঁজ নিয়ে জানলাম তিনি মোটিভেশনাল স্পিকার। সঙ্গে ক্যারিয়ার বিশ্লেষক বা ওরকম কিছু। তা তরুণরা যখন এত ভক্ত, তখন নিশ্চয়ই অনুপ্রেরণাদায়ী কিছু কথাবার্তা শোনা যাবে।

তিনি শুরুই করলেন, ‘‘তোমাদের স্বার্থপর হতে হবে'' এই বলে...। শুনে হা হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার হা হওয়াটাই একমাত্র ঘটনা নয়। আরো বড় ঘটনা হলো, কান ফাটানো হাততালি।

তার মানে, স্বার্থপর হওয়ার ব্যাপারটা পরের প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যাপার। এই তথাকথিত মোটিভেশনাল স্পিকাররা এদের আত্মকেন্দ্রিক করার যাবতীয় শিক্ষা ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছে।

এরপর বলা হলো, ‘‘সবসময় নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে হবে। অ্যাটেনশন সিকার হতে হবে।'' প্রয়োজনীয় অঙ্গভঙ্গি আর কিছু আপত্তিকর শব্দ দিয়ে এমন উপস্থাপনা যে, দেখে  আমার প্রায় দমবন্ধ অবস্থা। ওদিকে হাততালিতে কানও ফেটে যাচ্ছে।

তিনি তখন চলে গেছেন প্রিয়াঙ্কা চোপরাতে। প্রিয়াঙ্কার ‘মুঝে সব কুছ চাহিয়ে (আমার সবকিছু চাই)' বলে যে কথাটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এর চেয়ে অতুলনীয় অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্য নাকি আর কিছু হতে পারে না।

আমার হা আরো বড় হয়। ওদিকে হাততালির শব্দ আরো জোর পায়। বুঝলাম, মগজ ধোলাইটা এই পর্যায়ে গেছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পরের প্রজন্ম পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, সব পাওয়ার নেশা ঢুকিয়ে একদল মতলববাজ তরুণদেরকে আশার নামে হতাশার অতলে ডুবিয়ে দিচ্ছে।

আমার তাই মনে হয়, তরুণদের এই হাতাতালিটাই দুশ্চিন্তা। বেস্ট সেলারের তালিকা নয়।

প্রথমটার সমাধান করি। পরেরটা আপনাআপনিই ঠিক হয়ে যাবে।