1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতীয় রাজনীতির ‘শেষ ভদ্রলোকের' বিদায়!

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা       
১৩ আগস্ট ২০১৮

৮৯ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট বামপন্থি নেতা, আইনজীবী ও ভারতীয় সংসদের লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়৷ তাঁর মৃত্যু উসকে দিয়েছে পুরনো কিছু অপ্রিয় তর্ক৷

https://p.dw.com/p/334hr
ছবি: DW/P. Tewari

হিন্দু রীতিতে কবর দেওয়ার চল নেই৷ যদি থাকত, তাহলে প্রয়াত শ্রী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিফলকে নির্দ্বিধায় লিখে দেওয়া যেত— এমন একজন বামপন্থি, যিনি নিজের নীতি এবং বিশ্বাসের সঙ্গে কখনো আপোস করেননি৷ অবশ্য একজন আদর্শ বামপন্থির মতোই হিন্দু-মুসলিম, বা অন্য কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে কখনো সমর্থন করেননি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়৷ এমনকি রাজনৈতিক ভেদাভেদের ঊর্ধে ওঠার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন৷ ২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে সর্বসম্মতিক্রমে ভারতীয় সংসদের নিম্নতর কক্ষ লোকসভার অধ্যক্ষ মনোনীত হন তিনি৷ বিনা প্রতিদ্বন্দিতায়৷ দেশের সবক'টি রাজনৈতিক দল তাঁর মনোনয়নে এক কথায় সমর্থন জানিয়েছিল৷

তিনি সেই আস্থার অমর্যাদা করতে চাননি৷ লোকসভার অধ্যক্ষের দায়িত্ব তিনি দল-মত নির্বিশেষে পালন করেছেন৷ তাঁর দল সিপিআইএম যখন পরমাণু চুক্তির ইস্যুতে ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিলো, সোমনাথবাবুকেও অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দিতে বলেছিল দলীয় নেতৃত্ব৷ তিনি রাজি হননি৷ কারণ হিসেবে বলেছিলেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে অধ্যক্ষের আসনে নেই৷ এটি তাঁর সংসদীয় দায়িত্ব, যার সঙ্গে দলীয় মতামতের কোনো সম্পর্ক নেই৷ এই বক্তব্য, এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে তাঁর বড় ক্ষতি করেছিল, কারণ, তাঁকে বহিষ্কার করেছিল সিপিএম৷

১০ বারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তিনি৷ জীবনে একবারই নির্বাচনে হেরেছিলেন৷ ১৯৮৪ সালে, যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে, কংগ্রেস দলের নবীনা প্রার্থী মমতা ব্যানার্জির কাছে৷ ওই ঐতিহাসিক জয় মমতাকে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আসার প্রথম সুযোগ করে দিয়েছিল৷ কিন্তু ওই একবারই হার৷ নয়ত ১০ বার মানুষের সমর্থন নিয়েই নির্বাচিত হয়েছেন৷ চাইলেই অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারতেন৷ তাঁর মতো দাপুটে সাংসদ, তুখোড় বক্তা, অভিজ্ঞ রাজনীতিক, আইনে পারদর্শী মানুষ যে কোনো রাজনৈতিক দলেরই সম্পদ হতে পারত৷ কিন্তু বহিষ্কৃত হয়েও বামপন্থি থেকে গেছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়৷ এমনকি দলের বিরুদ্ধে কখনো কোনো কথা বলেননি৷

মহম্মদ সেলিম

তাঁর মৃত্যুর পর অনেকেই বলছেন, ভারতীয় রাজনীতি থেকে শেষ ভদ্রলোকটি বিদায় নিলেন৷ সেই প্রসঙ্গটি তোলা হয়েছিল সিপিআইএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কাছে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‌‘‌পশ্চিমবঙ্গ থেকে সংসদে হীরেন মুখার্জি, ভূপেশ গুপ্ত, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, জ্যোতির্ময় বসুর মতো নেতাদের যে ধারা, তার একটা অন্ত হলো৷ এখন সাংসদদের যে মান, যাঁরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা কেউ মুখ খুলতে পারেন না, মুখ খুললে উলটোপালটা কথা বলেন!‌

স্বাধীনতার আগে থেকেই সংসদে বাংলার প্রতিনিধিদের যে সম্মান ছিল, এবং ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত একজন ভদ্রলোক, যিনি উচ্চশিক্ষিত, পড়াশোনা করেছেন, ভালো বলেন, এবং মেহনতি মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন— তিনি ভালো উকিল, ভালো বিচারপতি হতে পারতেন, লেখক হতে পারতেন, অন্য যে কোনো পেশায় গেলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারতেন৷ তার বদলে তিনি নিজের জীবন সঁপেছিলেন রাজ্যের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে৷'‌'‌

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় গত বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন৷ সোমবার সকালে দক্ষিণ কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান৷ তাঁর মরদেহ প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতা হাইকোর্টে৷ কেমব্রিজ থেকে ওকালতি পাশ করে এসে সেখানেই আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন৷

সেখান থেকে দেহ যায় রাজ্য বিধানসভায়৷ সেখানে গান স্যালুটের মাধ্যমে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে অভিবাদন জানানো হয়৷ তারপর দেহ যায় বাড়িতে৷ বামপন্থি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় মৃতদেহ সৎকারের রীতিতে বিশ্বাস রাখতেন না৷ নিজের দেহ তিনি দান করে গিয়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিতে৷ সেই ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী বাড়ি থেকে তাঁর দেহ নিয়ে গিয়ে সংরক্ষিত হয়েছে এসএসকেএম হাসপাতালে৷

সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই দলীয় নির্দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে লোকসভার অধ্যক্ষ পদে থেকে গিয়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সেই ‘‌অপরাধে’‌ দল তাঁকে বহিষ্কার করেছিল। ১৪ বছরেও সেই বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়নি।

সোমবার সোমনাথবাবুর মৃত্যুর পর সিপিআইএম দলের নেতারা তাঁর বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে, তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। মরদেহে বিছিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লাল পতাকা। সেই পতাকাও ফিরিয়ে দেন সোমনাথবাবুর সন্তানেরা।

আমৃত্যু বামপন্থি মানুষটির শবাধারে তাই ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে রইল লাল পতাকার অনুপস্থিতি। সাদা চাদরেই ঢাকা ছিল মৃতদেহ। সেই সাদা রঙ সোমনাথবাবুর চরিত্রের মতই শ্বেতশুভ্র, নিষ্কলঙ্ক।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য