1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাসায়নিক নয়, সমস্যা অনিয়ম আর অবহেলায়

প্রভাষ আমিন
১০ জুন ২০২২

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি আর দশটি সাধারণ আগুনের মত পত্রিকার পেছনের পাতার নিউজ হয়েই হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারতো৷

https://p.dw.com/p/4CVgW
Bangladesch | Unglück | Feuer-Explosion in Sitakunda
ছবি: Al Mahmud BS/REUTERS

কিন্তু সেই ডিপোর কন্টেইনারে লুকিয়ে থাকা গুপ্তঘাতক হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ঘটনাটিকে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেয়নি৷ বরং হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে বিস্ফোরিত আগুন৷ প্রায় তিনদিন ধরে জ্বলতে থাকা আগুন, তার ধোয়া আর শোকের চাদরে ঢেকে গেছে গোটা দেশ৷ ব্যাপারটি এমন নয় যে, এই প্রথম বাংলাদেশে রাসায়নিকের কারণে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটলো৷ এর আগে পুরান ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টা, নারায়ণগঞ্জের সেজান জুসের কারখানার অগ্নিকাণ্ডেও মূল ঘাতক ছিল রাসায়নিক৷ এ ধরনের অগ্নিকান্ডের পর এমনভাবে হৈচৈ শুরু হয়, যেন পারলে এখনই বাংলাদেশে সব ধরনের রাসায়নিক নিষিদ্ধ করে দেয়া উচিত৷ সব দোষ যেন রাসায়নিকের৷ তবে আমাদের ভাবনাটা বদলানোর সময় এসেছে৷ সমস্যাটা রাসায়নিকের নয়; মূল সমস্যা আমাদের অনিয়ম, দুর্নীতি, খামখেয়াল আর নজরদারির অভাবের৷

রাসায়নিক থাকলে আগুনের ভয়াবহতা বাড়ে, এটা যেমন সত্যি; তাহলে আগুন আছে বলেই আগুন লাগে, এটা তো আরো বড় সত্যি৷ তাহলে কি আগুন নিষিদ্ধ করে দিতে হবে৷ রাস্তায় নামলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে, তাহলে কি রাস্তা-গাড়ি সব বন্ধ করে দিতে হবে৷ আসল কথা হলো, মাথা কাটা নয়, ব্যথাটা দূর করতে হবে৷ অগ্নিকাণ্ডের ঝূকিঁ সত্বেও আগুনে ভর করেই কিন্তু সভ্যতা এগিয়েছে, জ্বলেপুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যায়নি৷ বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও কৃষি, তৈরি পোশাক আর রেমিটেন্সের ওপর ভর করে দাড়িয়ে আছে৷ কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরেক ধাপ এগিয়ে শিল্পায়নে নজর দিতে হবে৷ আর শিল্পায়নের যত বিস্তার হবে, ততই বাড়বে রাসায়নিকের ব্যবহার৷ তাই অগ্নিকাণ্ডের দায় আগুনের ওপর চাপিয়ে যেমন পার পাওয়া যাবে না, তেমনি ভয়াবহতার দায়ও রাসায়নিকের ওপর চাপিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করা যাবে না৷

আসল কথা হলো, দুর্যোগের ধরণ অনুযায়ী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে৷ সাধারণ আগুন পানিতে নেভানো যায়৷ কিন্তু রাসায়নিকের আগুন পানিতে আরো বাড়ে৷ কবি হেলাল হাফিজ যেমন অনেক আগেই লিখেছেন, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’, তেমনি রাসায়নিকের আগুন জলে নিভবে না, আরো জ্বলবে৷ তাই রাসায়নিকের আগুন নেভাতে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে৷ প্রতিবারই কোনো ঘটনা ঘটলে, আমরা বলি, আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে৷ কিন্তু ঘটনা থেমে যাওয়ার পর আমরা আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ি৷ আবার আগুন লাগলে তার উত্তাপে আমাদের ঘুম ভাঙে, চোখ খুলে যায়৷ চোখ যদি সত্যি সত্যি খুলে যেতো, তাহলে তো নিমতলীর পর আর রাসায়নিকের কারণে প্রাণহানি ঘটতো না৷ কিন্তু বাস্তবতা হলো রাসায়নিক এখনও আমাদের বিপদ হয়ে ঝুলে আছে৷ আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, পুরান ঢাকার ঘনবসতি এলাকায় অভিযান চালালে এখনও বিপদজনক রাসায়নিকের গোডাউন মিলবে৷ আবার আরেকটি আগুনে রাসায়নিক ভয়াবহতা ডেকে আনলে আমরা আবার জেগে উঠবো৷

কবে যে আমাদের ঘুম একেবারে ভাঙবে৷ আমাদের ব্যবস্থাপনার এই ঘুমপ্রীতি চিরঘুমে পাঠিয়ে দিচ্ছে কত মানুষকে৷ সীতাকুণ্ডের ঘটনায় মারা গেছে মোট ৪৫ জন৷ এরমধ্যে ফায়ার ফাইটারই নয় জন৷ সীতাকুণ্ডের  আগে বাংলাদেশের ৫০ বছরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন ১৭ জন ফায়ার ফাইটার৷ আর সীতাকুণ্ডের এক ঘটনাতেই মারা গেলেন নয় জন৷ কারণ তারা জানতেন না কন্টেইনারের ভেতরে বিপদজনক হাইড্রোজনে পার অক্সাইড রয়েছে৷ তারা কাছে গিয়ে পানি দিয়ে আগুন নেভাতে চেয়েছিলেন৷ আর তাতেই ঘটে বিস্ফোরণ৷ তারা যদি জানতেন, কন্টেইনারে রাসায়নিক আছে, তাহলে তারা নিশ্চয়ই অত কাছে যেতেন না, পানির বদলে অন্য ব্যবস্থা নিতেন৷ এইটুকু তথ্য ঘাটতিই কেড়ে নিয়েছে অতগুলো প্রাণ৷ বিএম কন্টেইনার ডিপোর মালিকপক্ষ নিজেরা তো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেনইনি, সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যটিও জানাননি৷ বরং আগুন লাগার সাথে সাথে মূল গেট বন্ধ করে দিয়ে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন৷ এই মালিকপক্ষ প্রভাবশালী সন্দেহ নেই৷ বিএম ডিপোর মূল মালিকানা স্মাট গ্রুপের৷ তারা যে সত্যি সত্যি স্মার্ট তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷

এখন জানা যাচ্ছে, বিএম ডিপোর পদে পতে অনিয়ম৷ যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না, অগ্নি নির্বাপক প্রশিক্ষণ ছিল না, সঠিক তথ্য ছিল না৷ বিপদজনক হাউড্রোজেন পার অক্সাইডের উৎপাদক আল রাজি কেমিক্যালের মালিকানাও এই স্মার্ট গ্রুপেরই৷ সেই কারখানার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছিল না৷ সেই কারখানার বর্জ্য মিশতো হালদা নদীতে৷ এক অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা নিয়েই কিন্তু আল রাজি কেমিক্যালে রাসায়নিক উৎপাদন হতো এবং বিএম ডিপো দিয়ে রপ্তানি হতো৷ আগুন না লাগলে কিন্তু এই অনিয়ম নিয়েই যেমন চলছিলম তেমনই চলতো সবকিছু৷ চলা সম্ভব কারণ স্মার্ট গ্রুপের মালিকদের একজন মুজিবুর রহমান দৈনিক পূর্বদেশ'এর সম্পাদক৷ একই সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষও৷ আর কী চাই৷ একই সঙ্গে সরকারি দলের নেতা এবং গণমাধ্যমের মালিক৷ তার কোম্পানি কেন আইন মানবে, অনুমতির তোয়াক্কা করবে৷ তাই পদে পদে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা নিয়েই চলছিল বিএম ডিপো আর আল রাজি কেমিক্যাল৷ আগুন লাগার পর মালিকপক্ষের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ সঠিক তথ্যটি জানানোরও দরকার মনে করেননি তারা৷ পরে তারা মানুষের অমূল্য জীকন কিনতে চেয়েছেন অল্প দামে৷ মৃতদের জন্য ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়ে তারা মানবিক সাজতে চেয়েছেন৷ বড়লোকদের এই এক সমস্যা৷ সবকিছু তারা টাকার অঙ্কে মাপে৷ তারা যদি সবকিছু নিয়ম মেনে করতেন, তাহলে আগুন লাগলেও তা এত প্রাণঘাতী হতো না৷ তারা যেভাবে টাকা দিয়ে স্বজনের ক্ষতি পূরণ করতে চাইছেন, অতীতে নিশ্চয়ই তারা টাকা দিয়ে অনিয়ম কিনেছে৷ টাকা দিয়ে সব কেনা যায়, এই ধারণা আছে বলেই তারা নিয়মের ধার ধারেন না, কারখানায় ইটিপি বসান না, ডিপোতে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা রাখেন না, রাসায়ুনিক রাখার অনুমতি নেন না৷ বাংলাদেশে মোট ১৯টি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো রয়েছে৷ এই ডিপোগুলোকে বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বলা যায়৷ কারণ আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়ায় তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ৷ এখন দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতির এই লাইফলাইন একেকটা মৃত্যুকূপ হয়ে বসে আছে৷ আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, এই মূহুর্তে কঠোর অভিযান চালালে দেখা যাবে বাকি ১৮টি ডিপোও আসলে অনিয়মের ডিপো, মৃত্যুকূপ৷ কন্টেইনার ডিপোগুলো নিরাপদ রাখা এবং দেখভালে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান জড়িত- কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, বন্দর কর্তৃপক্ষ, কলকারখানা অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর৷ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, কেউই ঠিকমত তার দায়িত্ব পালন করেনি৷ এখন প্রশ্ন হলো, কেন করেনি? এটা কি অদক্ষতা,খামখেয়াল নাকি দুর্নীতি৷ প্রশ্ন করলেই শুনি, মনিটর করার মত পর্যাপ্ত লোকবল নেই৷ লঞ্চডুবি হলেও শুনি জাহাজ দেখভাল করার মত লোক নেই৷ বিআরটিএতে গাড়ির ফিটনেস দেখার মত পর্যাপ্ত লোক নেই৷ আমাদের দেশে এত মানুষ, অর্থনীতি এত এগিয়েছে; প্রয়োজনীয় লোকবল থাকবে না কেন? যেখানে মানুষের জীবন মরণের প্রশ্ন সেখানে ছাড় দেয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই৷ বিএম ডিপোর মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুদিন পর মামলা হয়েছে৷ যদিও কাউকে ধরা হয়নি এখনও৷ দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার করা হোক৷ পাশাপাশি ডিপো এবং কারখানা নিরাপদ কিনা, সেটা দেখা যাদের দায়িত্ব ছিল ধরা হোক তাদেরও৷ 

প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখক
প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখকছবি: DW

২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজার ধ্বস কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকেই৷ তবে সেই ধ্বসের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানা এখন অনেক বেশি নিরাপদ৷ কারণ কারখানা নিরাপদ না হলে আপনি ক্রেতা পাবেন না৷ এক হাজার ১৭৫ জন মানুষের জীবনের বিনিময়ে আমরা গার্মেন্টস কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ পেয়েছি৷ কারণ আন্তর্জাতিক মহল প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল৷ নিরাপদ করতে না পারলে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ না থাকায় নিমতলির পরও বন্ধ হয়নি রাসায়নিকের ঝুঁকি৷ বিএম ডিপোর আগুনের ক্ষয়ক্ষতি এখনও জানা যায়নি৷ তবে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার রপ্তানি পণ্যও পুড়ে গেছে বলে প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে৷ ৪৫ জন মানুষের জীবন আর হাজার কোটি টাকার ক্ষতির বিনিময়ে হলেও নিরাপদ হোক আমাদের কন্টেইনার ডিপোগুলো, আপাতত এটুকু প্রত্যাশা৷