1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ছোটদের কীর্তি ম্লান বড়দের ভুলে

সুদীপ্ত আনন্দ
সুদীপ্ত আনন্দ
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ছোটদের মাঠের কীর্তি ম্লান হয়েছে বড়দের ভুলে৷ এর দায় কেবল একজনের নয়৷ দায়টা সবার৷

https://p.dw.com/p/4cDfH
Indien und Bangladesch - gemeinsame Meister der SAFF U19-Frauenmeisterschaft
ছবি: Bangladesh Football Federation

বড়রা নির্ভুল থাকলে জয় হতো ফুটবলের৷ জিততো বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নে বিভোর একঝাঁক নারী৷

শ্রীলঙ্কার ম্যাচ কমিশনারের মহাভুলে কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গিয়েছিল বৃহস্পতিবার৷ সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল৷ মাঠে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে স্বাগতিক বাংলাদেশ ও ভারত৷ রোমাঞ্চকর ৯০ মিনিট শেষ ১-১ সমতায়৷ টাইব্রেকার, সাডেন ডেথের ভাগ্য পরীক্ষাও অমীমাংসিত৷ মীমাংসার আগ পর্যন্ত সাডেন ডেথপর্ব চলারই নিয়ম৷ তবে লঙ্কান ম্যাচ কমিশনার ডিলান ডি সিলভা জয়াসুরিয়া সেই নিয়ম ভুলে নির্দেশ দেন কয়েন টসের৷ তাতেই তিনি বনে যান ‘খলনায়ক'৷

তবে এ পরিস্থিতির দায় কেবল ডিলানের একার নয়৷ সম্মিলিত ব্যর্থতায় ঘটেছে এমন কলঙ্কিত ঘটনা৷ চার রেফারি, আয়োজক সাফ, বাংলাদেশ ও ভারত দলের অফিশিয়ালরাও অনেকাংশে দায়ী৷ এই ঘটনায় সাফ ও বাফুফের গ্রহণযোগ্যতাও হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ৷

ম্যাচ কমিশনারের কয়েন টসের ভুল সিদ্ধান্ত মেনে নেপালি রেফারি দুই দলের অধিনায়ককে ডেকে সারেন টসের আনুষ্ঠানিকতা৷ টসে জিতে ভারত সদলবলে মাতে উদযাপনে৷ সঙ্গে সঙ্গে স্বাগতিক শিবির থেকে হয় তীব্র প্রতিবাদ৷ কোচ, ম্যানেজাররা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন ম্যাচ কমিশনার ও রেফারিদের৷ অবস্থা বেগতিক দেখে মাঠে আসেন সাফের কর্তারা৷ নিয়ম-কানুন ঘেঁটে তারা ম্যাচ কমিশনারকে জানান, বড় ভুল হয়ে গেছে৷ নিয়ম বইয়ের কোথাও শিরোপা নিষ্পত্তিতে কয়েন টসের বিধান নেই! ভুল বুঝে ম্যাচ কমিশনার দু'দলের ম্যানেজারকে পেনাল্টি শুটআউট ফের শুরুর কথা বলেন৷ ততক্ষণে একপ্রস্থ শিরোপা উদযাপন শেষ ভারতীয়দের৷ আঙিনায় অন্য দলের উদযাপন দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে কমলাপুরের গ্যালারি৷ ভব্যতা ভুলে উচ্ছৃঙ্খল সমর্থকরা হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে মারছে ভারতীয়দের লক্ষ্য করে৷ বোতল, জুতো বৃষ্টির মতো ঝরতে শুরু করে কমলাপুরের টার্ফে৷

ম্যাচের একটি মুহূর্তে ভারতের খেলোয়াড়ের পায়ে বল, আটকানোর চেষ্টা সাগরিকার
তুমুল উত্তেজনার ম্যাচে আট মিনিটে দেয়া গোলে এগিয়ে যায় ভারতের মেয়েরা ছবি: Bangladesh Football Federation

ম্যাচ কমিশনারের নয়া সিদ্ধান্তে এবার ক্ষোভের আগুন ভারতীয় শিবিরে৷ এক পর্যায়ে সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে তারা মাঠ ছেড়ে যায়৷ অন্যদিকে ভারতীয় দল বের হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের মেয়েদের শুরু বিরামহীন অপেক্ষার৷ প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর আসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত৷ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান কাটছাঁট করে দুই অধিনায়কের হাতে শিরোপা তুলে দেন ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান৷ একটা রোমাঞ্চকর টুর্নামেন্টের হয় করুণ-কলঙ্কিত সমাপ্তি৷

অথচ এই পরিস্থিতি এড়ানো যেতো সহজেই৷ কয়েন টসের আগে শুধরে দেওয়া যেতো ম্যাচ কমিশনারকে৷ সেটা হয়নি৷ এখানেই একে একে বের হয়েছে অন্যদের ব্যর্থতা ও অসাড়তা৷

ম্যাচ কমিশনারের ভুলটা ধরিয়ে দিতে মাঠে ছিলেন চার চারজন রেফারি৷ ম্যাচ পরিচালনার আগে তারাও কি নিয়ম-কানুন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেননি? শিরোপার মীমাংসা যে কয়েন টসের মাধ্যমে হতে যাচ্ছে, সেটা রেফারিরা দুই দলের ম্যানেজারকে ডেকেও বলতে পারতেন৷ সেটাও তারা করেননি৷ তাই দায় আছে তাদেরও৷

ম্যাচে বল পায়ে এগিয়ে যাওয়ার একটি মুহর্তে বাংলাদেশর সাগরিকা
অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিটে গোল করে বাংলাদেশকে সমতায় ফেরায় সাগরিকাছবি: Mosaraf Hossain Bhuban

ম্যাচ কমিশনার যখন কয়েন টসের নির্দেশ দেন, সেই প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডাগআউটে প্রতিক্রিয়াহীন ছিলেন দুই দলের কোচ ও কর্মকর্তারা৷ তারাও ভাগ্য পরীক্ষায় জয়ের অপেক্ষায় ছিলেন৷ ভাগ্য যখন ভারতীয়দের পক্ষে যায়, তখন তারা উদযাপনে মেতেছেন৷ ভাবলেশহীন বাংলাদেশের কর্তারা শুরু করেছেন প্রতিবাদ৷ নিয়মটা যদি আগেই জানা, সাইফুল বারী-আমিরুল ইসলামরা কেন কয়েন টসের আগে প্রতিবাদ করেননি?

ম্যাচ কমিশনারের সঙ্গে টসের আগেই তারা কথা বলতে পারতেন৷

পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে যে তারা অক্ষম, তার আরেকটা বড় নমুনা ক্লান্ত-শ্রান্ত মেয়েগুলোকে শীত-শিশিরের রাতে খোলা আকাশের নীচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অহেতুক বসিয়ে রাখা৷ পাছে মাঠ ছাড়লে সিদ্ধান্ত বিপক্ষে যায়, সেই চিন্তা থেকেই তাদের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত৷

দায় আছে ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টেরও৷ তারাও টসের ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেনি৷ টস ভাগ্যটা বাংলাদেশের পক্ষে গেলে তারাও কি প্রতিবাদমুখর হতো না? অথচ টসে জেতার পর আন্তর্জাতিক নিয়ম ভুলে তারা মেতেছে উদযাপনে৷ পরে ম্যাচ কমিশনার যখন পেনাল্টি শুটআউট চালিয়ে যাওয়ার কথা বললেন, তখন তারা প্রতিবাদ করেছে এবং মাঠ ছেড়ে গেছে৷

আবার আড়াই ঘণ্টা পর শিরোপা ভাগাভাগির প্রস্তাবে রাজি হয়েছে৷ তবে পুরো দল নিয়ে মঞ্চের সামনে আসেনি৷

মাঠে বাংলাদেশের হতাশ খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের প্রতিবাদের মুহূর্ত
জয়-পরাজয় নির্ধারণী টসে হারার পর বাংলাদেশের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা শুরু করেন প্রতিবাদছবি: Mosaraf Hossain Bhuban

এবার আসা যাক সাফ প্রসঙ্গে৷ দীর্ঘদিন এর সভাপতি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনপ্রধান কাজী সালাউদ্দিন৷ তার রানিং মেট আনোয়ারুল হক হেলাল৷ চার মেয়াদে তাদের নেতৃত্বে সাফ এগোয়নি একরত্তিও৷ একটা বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট আয়োজন তারা লেজেগোবরে করে ফেলেছেন৷ বাইলজে কোনো দল খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মাঠ ছেড়ে গেলে, ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর যদি সেই দল না ফিরে আসে তবে প্রতিপক্ষকে জয়ী ঘোষণার বিধান রয়েছে৷ সাফের কর্তারা সেটা ভুলে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অন্যভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে৷ শ্যাম-কূল দুটোই যে রক্ষা করতে হবে!

ক্রিকেটের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলেরও ‘মোড়ল’ ভারত৷ বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের যুক্ত থাকা ভীষণ জরুরি৷ মোড়লরা ক্ষেপে যদি সাফের টুর্নামেন্ট বয়কট করে, তাহলেই তো সর্বনাশ৷ দৃশ্যত তাই নিয়মের তোয়াক্কা না করে সাফ কর্তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভারতীয় ফুটবল প্রশাসনকে দুই পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য একটা সমাধানের পথে আনতে৷ সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে ফোন করে বোঝানোর চেষ্টায় কেটে যায় অনেক সময়৷ বেঁকে বসা ভারতীয় দলকে বোঝাতে ভারতের হাইকমিশনারকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়৷ এ সবকিছুতেই প্রকাশ পেয়েছে সাফ কর্তাদের সাংগঠনিক দেউলিয়াত্ব৷

দায় আছে আয়োজক বাংলাদেশেরও৷ প্রথমত নারী ফুটবলের যেকোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট বা ম্যাচের জন্য তারা বেছে নেয় ‘মৃত্যুকূপ’খ্যাত কমলাপুরের কৃত্রিম মাঠকে৷ এখানে খেলায় চোট-ঝুঁকি সর্বোচ্চ পর্যায়ে৷ ফিফা তাই এর অনুমোদন তুলে নিয়েছে৷ সাফ সেটা করেনি বলে এখানেই হয় সব খেলা৷ এ মাঠের ভেতর-বাইরের পরিবেশ নিয়ে অতিথি দলগুলো প্রায়ই প্রশ্ন তোলে৷ নিরাপত্তা নিয়েও আছে প্রশ্ন৷ তবে বাফুফে বিকারহীন৷ এসব তারা পাত্তা দেয় না বলেই অতিথি দলের ওপর ঝরে বোতল-জুতোর বৃষ্টি৷ এএফসি কিংবা ফিফার টুর্নামেন্ট হলে নিশ্চিত এ ঘটনায় বাফুফেকে পেতে হতো বড় শাস্তি৷

ম্যাচের ফল ঘোষনার পরে পতাকা হাতে বাংলাদেশ দলের ফটোসেশন
দুই দলের মধ্যে শিরোপা ভাগাভাগির ঘোষণায় স্বস্তি ফেরে বাংলাদেশ শিবিরেছবি: Bangladesh Football Federation

বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনার পর উত্তাল সোশ্যাল মিডিয়া৷ প্রতিবেশী দুই দেশের সমর্থকরা সমানে চালাচ্ছেন কথার লড়াই৷ তাতে যোগ হচ্ছে খিস্তি-খেউড়, যা কখনো কখনো খেলার মাঠে সীমাবদ্ধ থাকছে না, এর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে জাতীয়তাবাদ, মাত্রাতিরিক্ত দেশাত্মবোধ৷ একে অন্যকে ছোট করার হীন লড়াইয়ে প্রকাশিত হচ্ছে দুই দেশের একে অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধা, অসহমর্মিতা৷ এর মাঝেই একজনের একটা পোস্ট বেশ মনে ধরলো, "আপনার জীবন কি একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে? বোরিং? উত্তেজনা দরকার? ভাল্লাগছে না? চার্ম পাচ্ছেন না? আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন সবকিছু থেকে? মনোযোগ দিতে পারছেন না ঠিকমতো? একটু নাটকীয়তা চাই? ওকে! যে কোনো স্পোর্টসে, যে কোনো ফরম্যাটে, নারী-পুরুষ, জাতীয় বা বয়সভিত্তিক, বাংলাদেশ-ভারতের যে কোনো দুটি দলকে শুধু মাঠে নামিয়ে দিন! ব্যস!"

নির্জলা সত্য৷ ক্রিকেট বলুন কিংবা ফুটবল অথবা অন্য কোনো খেলা৷ দুই দেশ যখন মুখোমুখি অবস্থানে, তখন সেটা আর খেলা থাকছে না৷ জড়িয়ে যাচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক কিছু৷ এর সঙ্গে যদি ডিলানের মতো মানহীন ম্যাচ কমিশনার দায়িত্বে থাকেন, এক ভুল সামাল দিতে ভুলের মালা গাঁথা সাফ, বাফুফে ও দু'দলের কর্তারা যখন যুক্ত হন, তবে তো কথাই নেই৷

বড়দের ভুলে ছোটদের কীর্তি ম্লান হয়েছে এতে৷ তার আগে মাঠে দু'দলের মেয়েরা জানবাজি রেখে খেলেছে৷ হারের আগে তারা হারেনি৷ অথচ উনিশের সেই সাগরিকা-নেহাদের সত্যিকারে জিততে না দিয়ে নিজেদের হারিয়ে দিলেন বড়রা৷

বাংলাদেশের সানজিদার ইস্টবেঙ্গলে অভিষেক

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান